দেশটা যেমন আওয়ামী লীগ-বিএনপিতে বিভক্ত। তেমনই দূরদেশ কাতারের রাজধানী দোহাতে পৌঁছে শুনলাম একই কাহিনী। টানটান উত্তেজনা চারদিকে। তবে এখানে উত্তেজনা ভিন্ন কারণে। ফুটবল জ্বরে কাঁপছে রীতিমতো। শুধু কাতারে নয়, গোটা আরব দুনিয়ায়। পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে একই আলোচনা- কে হবেন বিশ্ব ফুটবলের নতুন রাজা। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এখানেও আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের বিভক্তি স্পষ্ট। বাড়িতে বাড়িতে পতাকা উড়ছে। বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে বরাবরই এমন দৃশ্য আমরা দেখে থাকি।
এই ফুটবল নিয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামা যে হয়নি তা কিন্তু নয়। ১৯৯০ থেকে ২০২২, এই দীর্ঘ সময়ে ফুটবলের উন্মাদনা দেখেছি। বাড়িতে বাড়িতে দুটো দেশের পতাকায় যেভাবে ঢেকে যায় তা দেখে মনেই হয় না আমরা তৃতীয় কোনো দেশের নাগরিক।
বাংলাদেশে ফুটবল নেই। আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশের স্থান একদম তলানিতে। তাতে কি! ফুটবলের অগণিত ভক্ত রয়েছেন। বিশ্বকাপ চলাকালে আমরা খবর হই। বিশেষ করে ডিয়াগো ম্যারাডোনার জন্য আমরা হাসি, কাঁদি। তার জন্য নফল নামাজ পড়ি। ১৯৯৪ সনে যেদিন ম্যারাডোনাকে ফুটবল মাঠ থেকে বহিষ্কার করা হয় সেদিন দুনিয়া কেঁদেছে। বাংলাদেশে ছিল রীতিমতো আহাজারি। গোটা বাংলাদেশ কেঁদেছিল। কেউ পড়েছিলেন নফল নামাজ। এমনকি খেলা নিয়ে ম্যারাডোনার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে বউ তালাকের ঘটনাও ঘটেছিল। এবার ম্যারাডোনা নেই। ফুটবলের এই ঈশ্বর আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু রয়েছে তার আর্জেন্টিনা। রয়েছেন তার যোগ্য উত্তরসূরি লিওনেল মেসি। লড়াইটা কি তাহলে মেসি-নেইমারের সঙ্গেই হবে! আমরা অংক মেলাতে পারি যেমনটা প্রতিবারই মেলানো হয়। কিন্তু গোলমাল হয়ে যায় মাঠে। ফুটবল ভক্তরা চান লড়াই হোক এই দু’জনের মধ্যেই। যদিও কেউ হারতে চান না। বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগ- বিএনপির যে লড়াই চলছে, তবে এটা সে লড়াই নয়। আওয়ামী লীগ- বিএনপির মধ্যে কোনো সংলাপ নেই। একে অপরের সঙ্গে কথা বলেন না। এমনকি বিয়ের অনুষ্ঠানেও যোগ দেন না। তৃতীয়পক্ষের দূতিয়ালির দিকেই চেয়ে থাকেন। কিন্তু হয় না কোনো সমঝোতা। ব্রাজিল- আর্জেন্টিনা চিরশত্রু। কেউ হারতে চান না। খেলার মাঠে ঠিকই লড়াই হয় তাদের মধ্যে। আওয়ামী লীগ- বিএনপির লড়াই দীর্ঘদিনের। ময়দানে লড়াই হয় না। অথচ এ লড়াই হতে পারতো ভোটে। ভোটের যে দেখা নেই। রাজপথ তো লড়াইয়ের জায়গা নয়।
শুক্রবার রাত ১১ টা। বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটটি কাতারের রাজধানী দোহা স্পর্শ করলো। তখন মনে হলো অন্য এক দুনিয়ায় পৌঁছে গেছি। আলো ঝলমল করছে। আরও একাধিকবার দোহায় এসেছি। কিন্তু এবার দোহা যেন অপরিচিত এক শহর। মিনিটে মিনিটে ফ্লাইট নামছে। অগণিত ফুটবলভক্ত আসছেন। ভাবা যায় আরব দুনিয়ায় ফুটবল! মরুভূমিতে ফুটবল হতে পারে, কিন্তু বিশ্বকাপ হয় কীভাবে? এটা একদিন স্বপ্ন ছিল। এখন বাস্তব। কাতারের যোগ্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। প্রচণ্ড সমালোচনা ছিল। সংশয় ছিল। ছিল নানা রকমের গুজব। বলা হচ্ছিল, কাতার বিশ্বকাপ আয়োজন করতে পারবে না। অনেকেই বলছিলেন আরব দুনিয়ায় মারণাস্ত্রের যুদ্ধ হতে পারে। যেমনটা একাধিকবার হয়েছে। ফুটবল যুদ্ধ কি করে হয়! এই প্রচণ্ড গরমের মধ্যে আর যাইহোক ফুটবল হয় না। কিন্তু কাতার প্রমাণ করেছে দুনিয়াতে অসম্ভব বলতে কিছু নেই। এই গরমের কারণে বিশ্বকাপ ফুটবলের নির্ধারিত সময় জুন-জুলাই মাসে এর ব্যত্যয় ঘটলো কাতারে। নভেম্বর-ডিসেম্বরে খেলার আয়োজন দেখে পশ্চিমা গণমাধ্যম নানা সমালোচনা করেছে। অভিযোগ তুলেছে মানবাধিকারের। ‘সুবিধা নেয়ার অভিযোগে’ আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে ফিফার প্রেসিডেন্ট সেপ ব্লাটারকে। ফরাসি ফুটবল তারকা মিশেল প্লাতিনিও একই অভিযোগে অভিযুক্ত। শত শত শ্রমিক প্রাণ দিয়েছেন এই শোকেস স্টেডিয়াম বানাতে গিয়ে। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপালের শ্রমিকেরা আধুনিক ফুটবল লড়াইয়ের অবকাঠামো তৈরি করেছেন। এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক। ক’দিন আগে ব্লাটার নিজেই কবুল করেছেন, আরব দুনিয়ায় ফুটবলের অনুমতি দেয়াটা তার ভুল ছিল। এই মুহূর্তে কাতারে ২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ডিসেম্বরে কিছুটা কমতে পারে।
যা শুনেছিলাম তা কিন্তু নয়। ইমিগ্রেশনে কোনও ঝামেলা হয়নি। চল্লিশ সেকেন্ডেই ইমিগ্রেশন পার হলাম। হায়া কার্ডও দেখলেন না। শুধু ছবি দেখেই ওকে করলেন ইমিগ্রেশন কর্মী। লাগেজ এলো পাঁচ মিনিটে। এরপর নতুন বিস্ময়। ফ্রি সিম কার্ড। স্বেচ্ছাসেবকরা দাঁড়িয়ে আছেন সিমকার্ড নিয়ে। হায়াকার্ড স্ক্যান করার পর বাংলাদেশি এক স্বেচ্ছাসেবক বললেন, আপনার মোবাইলটা দিন। এক মিনিটের মধ্যে সিম সংযুক্ত হলো। বাইশশ’ মিনিট কথা বলা যাবে ফ্রি। তবে তিনদিন পর রিচার্জ করতে হবে। এর মধ্যে ইশতিয়াক কামাল পৌঁছে গেছেন। চলুন, গাড়ি রেডি। ইশতিয়াক ব্যবসা করেন। ৩৬ বছরের টগবগে এই যুবকটি একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। স্ত্রী, দুই ছেলে নিয়ে আনন্দেই আছেন। একটি সার্ভিস অ্যাপার্টমেন্ট আমার ঠিকানা। এখানেই থাকবো একমাস। বেশ সুন্দর অ্যাপার্টমেন্ট। দাম একটু বেশি। হোটেল নিয়ে প্রায় তিনমাস লড়াই করেছি। মেইলের পর মেইল পাঠিয়েছি। সবখানেই শুধু- নেই। শেষ পর্যন্ত নিউ ইয়র্ক প্রবাসী আমার এক ছোটভাই সারওয়ারের সহযোগিতায় এই অ্যাপার্টমেন্টের সন্ধান পেয়েছিলাম। ইশতিয়াক কামালকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। তিনি এই অসাধারণ কাজটি সম্পন্ন করেছেন।
কাতারের কোড ৯৭৪। এই কোডে নামকরণ করা হয়েছে একটি স্টেডিয়ামের। এর অল্প কিছু দূরেই সালাতা টাওয়ার। একশ গজ দূরে রয়েছে মেট্রো স্টেশন। কাতার খুব ব্যয়বহুল শহর। এটা কে না জানে! যে শহরে বিশ্বকাপের আসর বসছে সে শহরে উত্তাপ থাকবেই। এয়ারপোর্ট থেকে যখন অ্যাপার্টমেন্টে ফিরছি তখনো কিন্তু ফ্যান জোনে পার্টি চলছিল। চরম অর্থনৈতিক সংকটে কাঁপছে গোটা বিশ্ব। কিন্তু কাতারে এসে মনে হলো- আমরা অন্য এক দুনিয়ায়। কেউ হাসবেন, কেউ কাঁদবেন। এটাই তো ফুটবল।
আপনার মতামত লিখুন :