ঢাকা ০৪ অক্টোবর ২০২৪, শুক্রবার, ১৯শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
২৯শে রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থায়ন ও বাংলাদেশ প্রেক্ষিত


টেলিগ্রাম রিপোর্ট প্রকাশের সময় : নভেম্বর ১২, ২০২২, ৭:৩১ অপরাহ্ণ / ২৭২২০ ০
আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থায়ন ও বাংলাদেশ প্রেক্ষিত

টেলিগ্রাম রিপোর্ট : জলবায়ু সম্মেলন (কপ-২৭) এমন এক সময় অনুষ্ঠিত হচ্ছে যখন জ্বালানি ও খাদ্য সংকটের সাথে মুদ্রাস্ফীতি ও অর্থনৈতিক মন্দায় পৃথিবীব্যাপী অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট অনেকটা জটিল হলেও জলবায়ু অর্থায়ন যে সম্মেলনে আলোচনার কেন্দ্রে থাকবে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

জলবায়ু সহনশীল উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে আমাদের অভিযোজন ও গ্রিনহাউস গ্যাস প্রশমনে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তবে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আন্তঃসরকারি প্যানেল আই.পি.সি.সি যেমনটি বলেছে, জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধের সুযোগ ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। এ সুযোগ নিতে হলে, বাংলাদেশের মতো জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য পর্যাপ্ত আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থায়নের ব্যবস্থা জরুরি ভিত্তিতে করতে হবে।

বাংলাদেশের জ্বালানি ল্যান্ডস্কেপ

২০২১ সালের জুন মাসে, পরিবেশগত প্রভাব বিবেচনায়, বাংলাদেশ নতুন ১০ টি কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা থেকে সরে আসার ঘোষণা দেয়। এর আরেকটি কারণ ছিল, কয়লা ভিত্তিক প্রকল্পে অর্থায়নের অনিশ্চয়তা।

পরবর্তীতে, আগস্ট মাসে, জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক উইং ইউ.এন.এফ.সি.সি.সি. (UNFCCC) কে বাংলাদেশের দাখিল করা পরিমার্জিত ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশন (এন.ডি.সি.) এ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাসে উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন দেখা যায়। লক্ষ্যমাত্রা হলো, নিজস্ব সক্ষমতায় ২০৩০ সাল নাগাদ, জ্বালানি, শিল্প, কৃষি, বন ও বর্জ্য খাতে, সর্বসাকুল্যে ৬.৭৩% গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমণ কমানো। তবে আর্থিক, প্রযুক্তি ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে উন্নত বিশ্বের সহায়তা পেলে, বাংলাদেশ আরো ১৫.১২% গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমাতে সক্ষম হবে।

এদিকে নভেম্বর ২০২১ এ, বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা দেয় ২০৪১ সালের মাঝে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৪০% বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। বলে রাখা ভালো, নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ১০% বিদ্যুৎ উৎপাদনের ২০২০ সালের লক্ষ্যমাত্রা এখনো পূরণ হয়নি। যে কারণে, নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্প বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত ও নতুন  লক্ষ্যে পৌঁছতে, সরকার উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর থেকে প্রযুক্তি ও আর্থিক সহায়তা আশা করছে ।

ইউক্রেইন্ ও রাশিয়ার মধ্যে চলমান যুদ্ধের ফলে অস্থিতিশীল জীবাশ্ম জ্বালানির বাজারের প্রভাব অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও পড়েছে ।

ব্যয়বহুল তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস এবং তেলের কারণে, সরকার জ্বালানি আমদানি কমাতে বাধ্য হয়েছে। ফলশ্রুতিতে, অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রাখতে হচ্ছে এবং বিদ্যুতের সংকট জনজীবনে প্রভাব ফেলার পাশাপাশি শিল্পখাতকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে । মাত্রাতিরিক্ত আমদানি নির্ভরতায়, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে যা পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী ৩০,২৫১ কোটি টাকা ।

পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ও গ্রিনহাউস গ্যাস প্রশমনে খরচ

পরিবেশ বান্ধব জ্বালানি বাস্তবায়নে বাংলাদেশের নিজস্ব কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে । আর ইউক্রেইন্-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে বিশেষত আমদানি ব্যয় মেটাতে গিয়ে তৈরী হওয়া আর্থিক চাপ পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে । কাজেই নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রসারে আন্তর্জাতিক সহায়তা যেমন জলবায়ু অর্থায়নের গুরুত্ব আরো সুস্পষ্ট হচ্ছে ।

গড়পড়তা হিসাব করলেও, ২০৪১ সাল নাগাদ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৪০% বিদ্যুৎ পেতে, এখন থেকেই প্রতিবছর ১.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা তার বেশি বিনিয়োগ করে যেতে হবে। আর এন.ডি.সি. অনুযায়ী গ্রিনহাউস গ্যাস প্রশমনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে, ২০৩০ সাল পর্যন্ত অনুমিত ব্যায় ১৭৬ বিলিয়ন নার্কিন ডলার ।

জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত এক দেশের নাম বাংলাদেশ

জলবাযু পরিবর্তনের প্রভাবে বন্যার হার, তীব্রতা এবং স্থায়িত্ব বাংলাদেশে বেড়েই চলেছে। এতে মানুষের জীবন ও জীবিকার সাথে বিভিন্ন অবকাঠামোর ক্ষতি হচ্ছে । প্রায় প্রতি বছর, সংঘটিত হওয়া ঘূর্ণিঝড়ের ফলে, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকার পানিতে মাত্রাতিক্ত ভাবে লবণাক্ততা বেড়েছে । এতে সীমান্তবর্তী প্রায় ২ কোটি মানুষ সুপেয় পানির সমস্যায় রয়েছে এবং কৃষিকাজের ও ক্ষতি হচ্ছে ।

যদিও বাংলাদেশ বন্যা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অনেক অগ্রগতি করেছে এবং স্থানীয়ভাবে পরিচালিত অভিযোজনে বিশ্বে নেতৃত্বও দিচ্ছে,  তবে তা যথেষ্ট নয় কেননা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রতি বছর বিপুল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে দেশ। সম্প্রতি প্রকাশিত স্টকহোম এনভায়রনমেন্ট ইনস্টিটিউট এর প্রতিবেদনে জানা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সংঘটিত ক্ষতি মোকাবেলায় ও মেরামতে বাংলাদেশের গ্রামীণ পরিবারগুলো  বছরে প্রায় ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে ।  উল্লেখ্য যে, এ ব্যয় বাৎসরিক সরকারি ব্যয়ের প্রায় দ্বিগুন এবং বহুপাক্ষিক সংস্থাগুলোর অবদানের ১২ গুনের বেশি। এ থেকে সহজেই অনুমেয়, আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থায়ন বাংলাদেশের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ ।

জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায়, দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার জলবায়ু অর্থায়ন ছাড় নিশ্চিত করতে, ধনী দেশগুলোর প্রতি ইউ.এন.এফ.সি.সি. এর গত বছরের আহবান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলা যায় । তবে ২০১০ সালে, মেক্সকোর কানকুন শহরে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনে, উন্নত দেশগুলোর প্রতিশ্রুত বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার জলবায়ু অর্থায়ন বর্তমান সময়ে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর চাহিদার তুলনায় খুবই অপ্রতুল মনে হয় ।

কপ-২৭ থেকে ভালো ফলের প্রত্যাশা

ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিক্স এন্ড ফিনান্সিয়াল এনালাইসিস (আই.ই.ই.ফা.) আশা করে, উন্নত দেশগুলো কপ-২৭ সম্মেলনে জলবায়ু অর্থায়নের পরিমাণ বাড়াতে অঙ্গীকার করবে এবং জলবায়ু অর্থায়ন নিয়ে সমালোচনা যেমন দৈত গণনা দূর করতে ব্যবস্থা নিবে। অর্থায়ন বরাদ্দে অভিযোজন ও প্রশমনে ভারসাম্যও বজায় রাখবে। এবারের সম্মেলনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, ক্ষয়-ক্ষতি (loss and damage) বিষয়ক তহবিল আলোচনার বিষয়-বস্তুতে সংযুক্ত হয়েছে। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সহায়তা দেয়ার জন্য, উন্নত দেশগুলোর এখন একটি ক্ষয়-ক্ষতি তহবিল তৈরি করতে হবে। এক্ষেত্রে সেপ্টেম্বর ২০২২ এ, ডেনমার্ক জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে সহায়তা দিতে প্রাথমিকভাবে ১৩ মিলিয়ন ডলার এর অঙ্গীকার করে।

পরিশেষে, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি মূল্যের অস্থিরতা, অনেক দেশের জ্বালানি নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। সাথে তৈরী হয়েছে নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রসারে অনুকূল পরিবেশ। বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম নয়। তাই উন্নত দেশগুলো কপ-২৭ সম্মেলনে, বাংলাদেশের মতো দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি দ্রুত প্রসারে জলবায়ু অর্থায়নের পরিমান বৃদ্ধির অঙ্গীকার করতে পারে। এক্ষেত্রে যৌক্তিক ধাপ হিসেবে, উন্নত দেশগুলোকে ঐকমত্যে পৌঁছতে হবে ঠিক কবে নাগাদ তারা বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড় করতে পারবে এবং সাথে বর্ধিত অর্থায়নের একটি রূপরেখা তারা তৈরী করতে পারে।

অনেক সমালোচনা থাকলেও, বাস্তবতা হলো “কপ” একমাত্র প্ল্যাটফর্ম যেখানে বিভিন্ন দেশ তাদের প্রস্তাব উত্থাপন এবং তাতে অন্য দেশের সম্মতি অর্জন করতে পারে । যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তন এখন আমাদের সবার জন্যই হুমকি স্বরূপ, সব দেশের নেতাদের অবশ্যই বিজ্ঞান ভিত্তিক ও বাস্তব সম্মত পদক্ষেপ নেয়ায় ঐক্যমত্য অর্জন এবং উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য জলবায়ু অর্থ প্রদান দ্রুততার সাথে নিশ্চিত করতে হবে।

Archive Calendar

Mon Tue Wed Thu Fri Sat Sun
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
28293031