আমরা যদি সংস্কার চাই, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে একটু বেশি সময় দিতে হবে সেই কাজগুলো করার জন্য, যা দলীয় সরকার দ্বারা সম্পাদন সম্ভব নয় । দেশে ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে আইনি সংস্কার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অপ-রাজনীতি বন্ধ , অঙ্গ-সংগঠন কর্তৃক সড়কে ও বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি ও খাসজমি-দখল রোধে আইনি ব্যবস্থা শক্ত করা, সরকারি অফিসে ও সেবা প্রতিষ্ঠানে ট্রেড-ইউনিয়ন বা লাল-নীল দল নিষিদ্ধ হওয়া, ইত্যাদি কাজ সুশাসনের জন্য জরুরি। এসব কাজের জন্য পরিবেশ নিশ্চিত করা কোনো দলীয় সরকারের পক্ষে সম্ভব হয় না, কারণ রাজনৈতিক দলের মধ্যে যুক্ত থাকা স্বার্থান্বেষী গ্রুপ এগুলো বাস্তবায়িত হতে দেয় না । তাই বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে জাতীয় স্বার্থে সংস্কারমূলক এই কাজগুলো করার জন্য যৌক্তিক সময় দিতে হবে । তা না হলে সদ্য সমাপ্ত আন্দলনের সময় ঝরে যাওয়া এতগুলো প্রাণক্ষয় নিরর্থক হয়ে যাবে ।
সময় নিয়ে বিবেচ্য কাজগুলো করতে গেলে যারা বাধা দেবে তাদের বুঝতে হবে যে, ছাত্ররা আন্দোলন না করলে এবং আরও কয়েক বছর সরকার টিকে গেলে বিরোধী পক্ষের লোকের উপর দমন-পীড়ন অব্যাহত থাকতো । এখন অন্তত তারা সেসব থেকে রেহাই পেয়ে নিজেদের অবস্থান শক্ত করার সুযোগ পাবেন । তাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দেশের জন্য প্রয়োজনীয় কাজগুলো করতে একটি যুক্তিসঙ্গত সময় দিলে তার মধ্যে দেশের মঙ্গল রয়েছে বলে মনে হয় । তবে একটা কথা, অন্তর্বর্তী সরকারে যারা আছেন, তারা ক্ষমতায় থেকে যেন রাজনীতি শুরু না করেন । তাহলে হয়তো জনসাধারণের মনে তাদের প্রতি যে বিশ্বাস জন্মেছে,তাতে চিড় ধরতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ও ছাত্রদের লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি করার কোনো সুযোগ থাকা উচিত নয়। বড় দলের লেজুড়বৃত্তি ছাড়াই জাতীয় স্বার্থে কোনো আন্দোলনের দরকার হলে নির্দলীয় অবস্থান থেকে সাধারণ ছাত্ররা এগিয়ে আসে ।
রাজনীতির বাইরে থাকা সরকারি-বেসরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও আসে, সেকথা এবার প্রতিষ্ঠিত হলো । অপরদিকে লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি থাকার সুবাদে একটা সুবিধাবাদী শ্রেণি তৈরি হয় এবং জাতীয় স্বার্থের সাথে সংগতিপূর্ণ প্রস্তাবনার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে তারা দমন-পীড়নে শরীক হয় , তা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। তাই জাতীয় রাজনীতির লেজুড় ছাত্র-রাজনীতি নিরুৎসাহিত বা নিষিদ্ধ করার ব্যবস্থা করতে হবে । একইভাবে বলা যায় যে, সরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারি সকলেই বেতন-ভাতা, পেনশন বা গ্রাচুইটি পায় একটা-না একটা আইনের আওতায়। আইন প্রতিপালিত না হলে কোর্ট বা এডমিনিসট্রেটিভ আদালত আছে ; দরকষাকষির জন্য ইউনিয়ন থাকার কোনো দরকার নেই । ইউনিয়ন থাকার অর্থ হচ্ছে এর ছত্র-ছায়ায় সাধারণ কর্মচারীদের চেয়ে কিছু লোকের বেশি সুযোগ নেয়া । এসব বন্ধ হতে হবে ।
উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিগণ যারা পাবলিক সার্ভেন্ট তাদের দ্বারা সড়কে চলাচলের ক্ষেত্রে বেশি সুযোগ নেয়ার জন্য জনগণের ভোগান্তি সৃষ্টি হয় । এমন সুবিধা নেয়া সমীচীন নয় যেটা জনস্বার্থে না হয় । ভিআইপি বা ভিভিআইপির জন্য সড়ক বন্ধ করে রাখার সংস্কৃতি ত্যাগ করতে হবে । যে-কোনো অজুহাতে সড়কে যান-চলাচল বন্ধ রাখা সমর্থনযোগ্য নয় । আগে দেখা গেছে প্রাতঃভ্রমণকারীদের পথ আটকে দিয়ে বলা হতো , এখন ফুটপাতে হাঁটা যাবে না , ভিভিআইপি এ পথে যাবেন । এগুলো উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে সম্ভব নয় । এবারের এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসব ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত পদ্ধতি কি–তা যদি জনগণকে দেখিয়ে দেয়, তাহলে তা একটা পূর্বনজির হতে পারে ।
( গাজী মিজানুর রহমান , সাবেক যুগ্ম-সচিব এবং লেখক )
আপনার মতামত লিখুন :