টেলিগ্রাম রিপোর্ট : বাংলাদেশের চলমান সংকট, শুধু যে রাজনৈতিক-রাষ্ট্রনৈতিক তাই-ই নয়, এখানকার সংকট বহুলাংশে নৈতিকও বটে। এই সময়ে নৈতিক মানুষ হিসেবে মাহবুব জামিল তাই আমাদের জন্য স্মরণযোগ্য। তার মৃত্যু আপাতত একটা সাময়িক বিচ্ছেদ বেদনা জাগাচ্ছে বটে, কিন্তু তা কখনই বিচ্ছিন্নতার দেয়াল তৈরি করতে পারবে না। কেননা সারাজীবনই তিনি শিল্পের সুসাংস্কৃতিক পরশ দিয়ে সকল প্রকার বিচ্ছিন্নতার দেয়ালকে ঠেকাবার চেষ্টা করেছেন। মানুষকে ভালোবেসে, বিনয় আর নম্রতায়, সত্য ও সুন্দরের সাধনা করে গেছেন জীবনভর। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, সিঙ্গার বাংলাদেশ, ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজসহ যেসব প্রতিষ্ঠানে তিনি থেকেছেন নানাভাবে সেসব প্রতিষ্ঠানের বহুবিধ সুকর্মই তাকে বাঁচিয়ে রাখবে বহু বছর মাহবুব জামিল (১৯৪১-২০২২) বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি বোর্ডের অন্যতম সদস্য ছিলেন। যখনকার কথা বলতে চাইছি, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি বোর্ডে তখন সব বিশিষ্ট ব্যক্তির সমাহার। তাদের মধ্যে দু’জন খুবই উজ্জ্বল মানুষ। এদের একজন ব্যাংকিং জগতের সৃজনশীল, মর্যাদাবান, নৈতিক মানুষ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর লুৎফর রহমান সরকার। অন্যজন করপোরেট জগতের আলোকিত মানুষ, সিঙ্গার বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাহবুব জামিল।
দু’জনের মধ্যে প্রভেদ অনেক আবার মিলও বিস্তর। প্রভেদ হচ্ছে কর্মপদ্ধতিতে। লুৎফর রহমান সরকার পাবলিক সেক্টর প্রমোট করেন, মাহবুব জামিল প্রাইভেট সেক্টর। লুৎফর রহমান সরকার রক্ষণশীল অর্থনীতির মানুষ, কিছুটা কৃচ্ছ্রতাসাধন ও মিতব্যয়িতার দ্বারা সমষ্টির কল্যাণ নিশ্চিত করতে উন্মুখ। মাহবুব জামিল মুক্তবাজার অর্থনীতির মানুষ, ব্যয় দ্বারা আয় ও কর্মসংস্থান তৈরির পক্ষপাতি। প্রাইভেট সেক্টরে ব্যবসা ও মুনাফা তার লক্ষ্য। লুৎফর রহমান সরকার পাবলিক সেক্টরকে হৃষ্টপুষ্ট করার মধ্যদিয়ে রাষ্ট্রের কল্যাণ নিশ্চিত করতে চান। মাহাবুব জামিল প্রাইভেট সেক্টরের বিকাশের মধ্যে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ খোঁজেন। তাদের এই বৈপরীত্য বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি বোর্ডের মিটিং পরিচালনার সময় মাঝে মাঝে স্পষ্ট হয়ে উঠতো।
কিন্তু লুৎফর রহমান সরকারকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন মাহবুব জামিল। ট্রাস্টি বোর্ডের মিটিংয়ে প্রতিটি এজেন্ডা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পড়ে আসতেন লুৎফর রহমান সরকার, দায়িত্ববান প্রজ্ঞায়। তিনিই থাকতেন মিটিংয়ের মধ্যমণি। তার মৃদুভাষ্যের দৃঢ়তাঋদ্ধ যেকোনো যুক্তিকে অগ্রাহ্য করার কথা ভাবতে পারতেন না কেউই। মাহবুব জামিলও নানারকম ছোটখাটো ভিন্নতা থাকার পরেও লুৎফর রহমান সরকারের কথাতেই সায় দিতেন শ্রদ্ধাভরা ভালোবাসায়। মিটিং শেষে ফিরে যেতেন নানান সব আলাপে। ‘লুৎফর ভাই’ সম্বোধনে কী যে সম্মান করে কথা বলতেন। অত বড় করপোরেট জগতের বস। অথচ কি অনাড়ম্বর। কি অসাধারণ নম্র বিনয়। পোশাকে ছিলেন খুবই ফিটফাট ও সুশ্রী। কিন্তু কখনোই তার বহিরাবরণ ভেতরের বিনয়কে আড়াল করতে পারতো না। একদিনের কথা মনে আছে। সেদিন ছিল বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি বোর্ডের মিটিং। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পুরনো বিল্ডিং তখনও রয়েছে। মিটিংয়ে এসেছেন মাহবুব জামিল। গেটের বাহিরেই গাড়ি ছেড়ে দিয়েছেন। গাড়ি আস্তে আস্তে আসছে। তিনি হেঁটে ঢুকছেন। গেটে ঢোকার মুখেই আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের সঙ্গে মাহবুব জামিলের দেখা।
স্যার খেয়াল করলেন পেছনে একটা নীল রঙের সম্পূর্ণ নিউ মডেলের মার্সিডিজ কার, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের গেটের দিকে এগুচ্ছে। সায়ীদ স্যার যাত্রীবিহীন কারটি দেখে, মাহবুব জামিলকে ইঙ্গিত করলেন, গাড়িটি কি আপনার? মৃদু হাসি দিয়ে যেন বিষয়টি এড়াতে পারলেই বাঁচেন তখন তিনি! স্যার তাঁর চিরাচরিত রসময় ভঙ্গিতে যখন গাড়ির বিষয়ে কথা বলতে চাইলেন, তখন মাহবুব জামিল, দ্রুত প্রসঙ্গান্তরে যেতেই ব্যতিব্যস্ত হলেন। অন্য কেউ হলে কি মডেলের গাড়ি, কত দাম দিয়ে কিনেছেন, কবে কিনেছেন-এসব জানাতেই গর্ববোধ করতেন। মাহবুব জামিল ছিলেন ঠিক তার উল্টো। কি বিপুলতর বিনয় আর নম্রতা ছিল তার আচরণে, ব্যবহারে তা বাস্তবে না দেখলে বিশ্বাস করাই কঠিন হতো। একবার তার ইন্টারভিউ নিতে গেছি সাপ্তাহিক পত্রিকার জন্য। বেশ সময় নিয়ে কথা বললেন। তখন তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এখনকার নতুন জেনারেশনের যারা করপোরেট জব করে, তাদের পোশাক-কথাবার্তা-আচরণে একটা মারমার কাট কাট, মচমচে ভাব। দারুণ ব্যস্ত, ক্ষিপ্রতায় ছুটছে সবসময়। এরা যেন হাঁটে না কেবল দৌড়ায়। করপোরেট জীবন শুরু করা এসব তরুণদের সামনে দাঁড়ানো যায় না, কথা বলা যায় না- এমনই অহংকারী-উগ্র অন্যকে অবজ্ঞার অবয়ব তাদের। অথচ আমেরিকান চেম্বারের সভাপতি, সিঙ্গার বাংলাদেশের চেয়ারম্যান- এত বড় একজন করপোরেট বস হয়েও আপনি এতটা নিরহংকারী, এতটাই বিনয়ী কেমন করে হলেন? এর অন্তর্নিহিত কারণই বা কী? উনি মৃদু হাসলেন। বললেন, দেখেন মূল পার্থক্য হচ্ছে ‘কালচারে’।
কালচারই মানুষকে বিনয়ী হতে শেখায়। যেসব তরুণদের আপনার কাছে দাম্ভিক মনে হচ্ছে, তারা যদি সুসংস্কৃত পরিবেশ পায়, তারাও বিনয়ী হয়ে উঠবে। কথাটা আমার মনকে ভীষণ নাড়া দিয়েছিল। আমার মনে পড়ে যায় বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের একটি বক্তৃতার কথা। সেখানে সংস্কৃতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘সংস্কৃতি কি? সংস্কৃতি হচ্ছে সত্য ও সুন্দরের সাধনা।’ আমার মনে হয়েছিল, মাহবুব জামিল হয়তো এভাবেই সংস্কৃতি দেখেছেন। শুধু দেখেন নাই, নিজের জীবনেও তার চর্চা করেছেন, সুশ্রীতায় এবং বিনয়ী পরিশীলনে। সবসময় হেসে কথা বলতেন, মৃদু স্বরে, মৃদুভাষ্যে, জড়তাহীন সাবলীলতায়। কিন্তু বিনয় ছিল তার নিত্যসময়ের সহজাত প্রবৃত্তি। সুস্থ ধারার চলচ্চিত্র আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন আমৃত্যু। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড এবং জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার কমিটির সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির যেকোনো ছোট-বড় উদ্যোগ তার কাছে সহযোগিতা পেতো অবলীলায়। বহু মানুষকে নীরবে সাহায্যও করতেন। একবার এক ক্যান্সার আক্রান্ত তরুণ কবির দুঃসময়ের সঙ্গী হতে যেয়ে শুনলাম ঢাকা শহরে তার প্রতিমাসের বাসা ভাড়া দিয়ে থাকেন মাহবুব জামিল, গোপনে-নীরবে, কোনো আওয়াজ ছাড়াই। যখন তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অংশ হলেন, সাংবাদিকতার সূত্রে জানতে পারলাম তার আরও অনেক খবর। ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মাহবুব জামিল। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হিসেবে মন্ত্রী পদমর্যাদায় বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন।
বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে যে সাহসিকতা, সততা, প্রজ্ঞা আর দূরদর্শিতার সঙ্গে সরাসরি নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে বোয়িং বিমান কেনাকাটার কাজে যুক্ত ছিলেন, সেটা ছিল এক অভাবনীয় ঘটনা। বলা হয় বাংলাদেশের ইতিহাসে সরকারের বিমান কেনাকাটার ক্ষেত্রে এ সময় যে স্বচ্ছতা-সততা-যোগ্যতার পরিচয় দেয়া হয় তা শুধু বিরলই নয়, উপমাযোগ্যও বটে। বিমান বাংলাদেশ পরিচালনার ক্ষেত্রেও তার সংস্কার কাজ এখন পর্যন্ত প্রশংসার যোগ্য বলেই বিবেচিত হয়। কোনো রকম বিতর্ক ও স্ক্যান্ডাল ছাড়াই করপোরেট জীবনেও তিনি অসামান্য সাফল্যের নমুনা রেখেছেন। সিঙ্গার বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও চেয়ারম্যান, সিঙ্গার এশিয়া এবং হংকং-এর আঞ্চলিক জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বহু রকম ব্যবসায়িক, সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন, সুসাংস্কৃতিক পরিচয় অব্যাহত রেখেই। মাহবুব জামিল সিনেমা, সংগীত, চিত্রকলা, সাহিত্য বলা যায় সংস্কৃতির নানান শাখায় একজন করিৎকর্মা পৃষ্ঠপোষক, সেবক ঘরানার মানুষ ছিলেন। ছিলেন পুরোদস্তুর করপোরেট জগতের কেজো মানুষও। কিন্তু এই দুই জগতের কোনোটাই তাকে তার মানবিক উৎকর্ষমণ্ডিত মননশীলতা থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। না শিল্পের অহমিকা, না ব্যবসার অহংকার, কোনোটাই তার মানবিক পরিচয়কে খাটো করতে পারে নাই। আমার নিজের কাছে এটা ছিল এক বিস্ময়।
কেননা শিল্পের অপার্থিব জগৎ আর ব্যবসার নগদকড়ির পার্থিব জগতের দু’জায়গাতেই তিনি সমানতালে চলেছেন, কাউকে বিন্দুমাত্র আঘাত না করে। এই যে সুসাংস্কৃতিক মানবিক মানুষ হয়ে থাকলেন মাহবুব জামিল জীবনভর, সেটাই তার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার বড় কারণ। এ রকম মানুষের সংখ্যা এখন বাড়ছে না, কমছেই কেবল। এই দুর্দিনে তাই মাহবুব জামিলের চলে যাওয়া আমাদের সবার কাছেই এক অপার বেদনার বিষয়ও বটে। বাংলাদেশের চলমান সংকট, শুধু যে রাজনৈতিক-রাষ্ট্রনৈতিক তাই-ই নয়, এখানকার সংকট বহুলাংশে নৈতিকও বটে। এই সময়ে নৈতিক মানুষ হিসেবে মাহবুব জামিল তাই আমাদের জন্য স্মরণযোগ্য। তার মৃত্যু আপাতত একটা সাময়িক বিচ্ছেদ বেদনা জাগাচ্ছে বটে, কিন্তু তা কখনই বিচ্ছিন্নতার দেয়াল তৈরি করতে পারবে না। কেননা সারাজীবনই তিনি শিল্পের সুসাংস্কৃতিক পরশ দিয়ে সকল প্রকার বিচ্ছিন্নতার দেয়ালকে ঠেকাবার চেষ্টা করেছেন। মানুষকে ভালোবেসে, বিনয় আর নম্রতায়, সত্য ও সুন্দরের সাধনা করে গেছেন জীবনভর। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, সিঙ্গার বাংলাদেশ, ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজসহ যেসব প্রতিষ্ঠানে তিনি থেকেছেন নানাভাবে সেসব প্রতিষ্ঠানের বহুবিধ সুকর্মই তাকে বাঁচিয়ে রাখবে বহু বছর। মাহবুব জামিল আমাদের ভালোবাসা জানবেন। যেখানেই থাকুন, ভালো থাকবেন।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
আপনার মতামত লিখুন :