টেলিগ্রাম রিপোর্ট : সাধারণত কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের ওপর নির্ভর করে সমুদ্রবন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের হিসাব করা হয়। দেশের অর্থনীতির প্রবেশদ্বার বলে পরিচিত চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে গত দুই মাস ধরে এই আমদানি-রপ্তানি পণ্য কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে। মূলত ডলার সংকটের কারণে ঋণপত্র খুলতে না পারায় আগের মতো পণ্য আমদানি করতে পারছে না ব্যবসায়ীরা। সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের অক্টোবর মাসে চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি পণ্যের কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে ৯৭ হাজার ৫৩৮ টিইইউস। যেটি সেপ্টেম্বরে ছিল ১ লাখ ১ হাজার ৪৯৩ টিইইউস। আর আগস্টে এটি ছিল ১ লাখ ১৪ হাজার ৯২০ টিইইউস। একইভাবে অক্টোবরে রপ্তানি পণ্য হ্যান্ডলিং হয়েছে ৫৯ হাজার ৩৩১ টিইইউস। এর আগে সেপ্টেম্বরে এটি ছিল ৬৩ হাজার ৮০৩ টিইইউস, আগস্টে ছিল ৭৫ হাজার ৬৯৭ টিইইউস। আগস্টের তুলনায় দুই মাসের ব্যবধানে রপ্তানি পণ্য হ্যান্ডলিং কমেছে ১৬ হাজার ৩৬৬ টিইইউস। আর রপ্তানি পণ্য হ্যান্ডলিং কমেছে ১৭ হাজার ৩৮২ টিইইউস।
কাস্টমস সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ভোজ্য তেল, গম, ছোলা, চিনি, মসুর ডাল, মটর ডাল, খেজুর, প্রসাধনী সামগ্রী, বিলাসবহুল পণ্য, শিল্প কারখানার কাঁচামাল, পাথর, বিভিন্ন ফল, অয়েল কেক, ছোলা, খেজুরসহ বিভিন্ন পণ্য উল্লেখযোগ্য হারে আমদানি হয়। তবে আগস্ট থেকে অক্টোবর এ তিন মাসে পণ্যগুলোর আমদানি কমেছে চোখে পড়ার মতো।
এর মধ্যে গত বছরের আগস্ট থেকে অক্টোবর চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ১৮০ কোটি কেজি গম, চিনি, ফল, মসুর ও মটর ডাল আমদানি হয়েছিল। আর চলতি বছরের এই তিন মাসে এই ৫টি পণ্য আমদানি হয় ১৪৪ কোটি কেজি। আর আগের চেয়ে এই পণ্যগুলোর আমদানি ৩৬ কোটি কেজি কমেছে। এদিকে, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে রপ্তানি আয়ের ৮০ ভাগই আসে পোশাক খাত থেকে। আর এই পোশাক খাতের প্রায় ৯০ শতাংশ কাঁচামাল আসে বিদেশ থেকে। ডলার সংকটের কারণে কাঁচামাল আনতে ভোগান্তিতে পড়ায় রপ্তানি আয়ও কমেছে অস্বাভাবিকভাবে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলতি বছরের আগস্টে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৩৭৪ কোটি ডলার মূল্যের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়। সেপ্টেম্বর মাসে এই আয় ৩১৬ কোটি ডলারে নেমে আসে। সর্বশেষ গত অক্টোবর মাসে এই আয় তলানিতে নেমে ২৩৭ কোটি ডলারে পৌঁছে। এর মধ্যে কাঁচামাল আমদানি করতে না পারায় কার্যাদেশ বাতিল হওয়ায় ছোটখাটো অনেক গার্মেন্ট মালিক তাদের কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। জানা যায়, কার্যাদেশ বন্ধ থাকায় দুই মাসের বেতন বকেয়া রেখে গত ১৭ই নভেম্বর চট্টগ্রাম নগরের বাকলিয়া ডিপ অ্যাপারেলস নামে একটি পোশাক কারখানা বন্ধ করে দেয় মালিকপক্ষ। কারখানাটিতে ৬ শতাধিক শ্রমিক কর্মরত ছিল। একপর্যায়ে শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকে। পরে এক মাসের মধ্যে বকেয়া বেতন বুঝিয়ে দেয়ার আশ্বাসে তারা রাস্তা থেকে সরে আসে। চট্টগ্রামের গার্মেন্ট ব্যবসায়ী ছামিম ফ্যাশনের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ ইসা মানবজমিনকে বলেন, টানা কয়েক মাস ধরে মন্দা যাচ্ছে।
ছোট বড় অনেক কারখানায় কাজ নেই। কয়েক মাসে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। অর্ডারের ধারাবাহিকতা ঠিক না থাকলে এ রকম আরও অনেক কারখানা শিগগিরই বন্ধ হয়ে যাবে। মূলত ডলার সংকট ও ইউক্রেন- রাশিয়া যুদ্ধের কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। গার্মেন্ট মালিকদের সবচেয়ে বড় সংগঠন বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি রাকিবুল আনোয়ার বলেন, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধসহ বিভিন্ন কারণে ক্রয়াদেশ কমে গেছে। যে কারণে রপ্তানি আয় নিম্নমুখী হয়ে পড়েছে। মনে হচ্ছে এ রকম আরও কয়েক মাস চলবে। বিষয়টি নিয়ে আমরা শঙ্কায় আছি। জানা যায়, গত আগস্টে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৫ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করে কাস্টমস। সেটি সেপ্টেম্বর মাসে কমে ৫ হাজার ১০৫ কোটি টাকায় পৌঁছে।
সর্বশেষ অক্টোবর মাসে এই রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ৪ হাজার ৯১১ টাকায় নামে। কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, বন্দরের মাধ্যমে যে আমদানি-রপ্তানি হয় তার ওপর ভিত্তি করে প্রতি বছর প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করে চট্টগ্রাম কাস্টমস। ডলার সংকট কাটাতে সরকার ১৩৫টি ধরনের বিলাসবহুল পণ্য আমদানিতে ২০ শতাংশ বেশি শুল্ক আরোপ করেছে। ফলে এসব পণ্যের আমদানি কমে গেছে। এ ছাড়া রপ্তানিও কমে গেছে অনেক বেশি। যে কারণে সরকারের রাজস্ব আদায় কমছে। চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, মূলত ডলার সংকটের কারণে আমদানি রপ্তানি নিম্নমুখী হয়েছে। ব্যবসায়ীদের এলসি খুলতে সমস্যা হচ্ছে। আর আমাদের রপ্তানি আয়ের সিংহভাগ আসে গার্মেন্ট খাত থেকে। এই খাতের কাঁচামাল শতভাগ আমদানিনির্ভর। এই কাঁচামাল ডলারেই আনতে হয়। আর কাঁচামাল আমদানিতে সমস্যা হওয়ায় রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
আপনার মতামত লিখুন :