ঢাকা ০৫ নভেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবার, ২০শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
১লা জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

দিন দিন ছোট হচ্ছে সুন্দরবন


টেলিগ্রাম রিপোর্ট প্রকাশের সময় : নভেম্বর ১৪, ২০২২, ৮:৫৪ অপরাহ্ণ / ২৭২২০ ০
দিন দিন ছোট হচ্ছে সুন্দরবন

টেলিগ্রাম রিপোর্ট :

প্রতিবছর ৩৫০টি ফুটবল মাঠের সমান বনভূমি বাংলাদেশ অংশের সুন্দরবন থেকে কমে যাচ্ছে। আয়তন কমে আসায় সুন্দরবনের প্রতিবেশব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কমে আসছে গাছ, লতাগুল্ম, প্রাণী। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে সুন্দরবন দুর্বল হয়ে পড়ছে।

বহু বছর ধরে সুন্দরবন দুর্বল হয়ে পড়ার ঝুঁকির কথা বলা হচ্ছে। বৃহত্তর খুলনা (খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা) জেলার গেজেটিয়ার লেখার কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৭০ সালে। ১৯৭৮ সালে ছাপা ওই গেজেটিয়ারে বলা হয়েছিল, নির্বিচার বনসম্পদ লুট ও প্রাণী হত্যা বন্ধ না হলে সুন্দরবন বিবর্ণ, বৃক্ষলতাহীন, প্রাণহীন হয়ে পড়বে। পাঁচ দশক পর পরিস্থিতি ততটা মারাত্মক না হলেও সুন্দরবনের প্রাণপ্রাচুর্য কমছে। গবেষকেরা বলছেন, সুন্দরবনের কিছু গাছ, প্রাণী ও পাখি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে।

২২ ফেব্রুয়ারি মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে লঞ্চে সুন্দরবনের শেষ প্রান্ত দুবলার চর যেতে এবং ২৪ ফেব্রুয়ারি দুবলার চর থেকে মোংলায় ফিরতে নদীপথে বড় বড় সমুদ্রগামী জাহাজ চোখে পড়ে। চোখে পড়ে ছোট-বড় নানা ধরনের মালবাহী নৌযান। ইঞ্জিনচালিত নৌকায় জেলেরা ফিরছেন মাছ ধরে, কেউ যাচ্ছেন মাছ ধরতে। বনের মধ্যে খালে ছোট নৌকায় করে মাছ ধরতে দেখা যায়। যাওয়া-আসার পথে দু-এক জায়গায় ডলফিন চোখে পড়ে। দুবলার চরে গিয়ে দেখা মেলে মাছরাঙা, বক, বানর, হরিণ আর বন্য শূকরের।

বনের জমি কমছে

বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বঙ্গোপসাগর উপকূলের বড় অংশজুড়ে সুন্দরবন। সরকারি দলিল অনুযায়ী, সুন্দরবনের ৬০ শতাংশ বাংলাদেশে, বাকি ৪০ শতাংশ পশ্চিমবঙ্গে। বাংলাদেশ অংশের সুন্দরবনে গাছ, লতাগুল্ম, পাখি, প্রাণী, মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণীর প্রজাতির সংখ্যা বেশি।

দুই বছর আগে ২০২০ সালে বিশ্বব্যাংক তাদের এক প্রতিবেদনে সুন্দরবনের আয়তন কমে আসার কিছু তথ্য প্রকাশ করে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সুন্দরবন ও বনসংলগ্ন এলাকার মানুষের টিকে থাকার বিষয়ে প্রতিবেদনটি করা হয়েছিল। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ১৯০৪-২৪ সালে দুই দেশের সুন্দরবনের আয়তন ছিল ১১ হাজার ৯০৪ বর্গকিলোমিটার। ১৯৬৭ সালে তা কমে হয় ১১ হাজার ৬৬৩ বর্গকিলোমিটার। ২০০১ সালে আয়তন কমে দাঁড়ায় ১১ হাজার ৫০৬ বর্গকিলোমিটারে। ২০১৫-১৬ সালে আয়তন ছিল ১১ হাজার ৪৫৩ বর্গকিলোমিটার। অর্থাৎ গত ১০০ বছরে সুন্দরবনের আয়তন ৪৫১ বর্গকিলোমিটার কমে গেছে।

ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের সুন্দরবনের আয়তন কমে যাওয়ার পৃথক কোনো পরিসংখ্যান দেওয়া হয়নি। তবে ওই পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ১৯০৪-২৪ সালে বাংলাদেশ অংশের সুন্দরবনের আয়তন ছিল ৭ হাজার ১৪২ বর্গকিলোমিটার। ২০১৫-১৬ সালে আয়তন কমে ৬ হাজার ৮৭১ বর্গকিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ১০০ বছরে সুন্দরবনের ২৫২ বর্গকিলোমিটার হারিয়ে গেছে। এর অর্থ, প্রতিবছর আড়াই বর্গকিলোমিটারের মতো বন হারিয়ে যাচ্ছে। এই পরিমাণ জমির আয়তন আন্তর্জাতিক ফুটবল সংস্থা ফিফার ৩৫০টি ফুটবল মাঠের সমান।

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ট্রাস্টি গবেষণা সংস্থা সিজিআইএসের নির্বাহী পরিচালক মালিক ফিদা আবদুল্লাহ খান ২০১৬ সালের এক গবেষণায় দেখিয়েছিলেন, সুন্দরবনের আয়তন কমছে, জলাভূমি বাড়ছে। বনাঞ্চলে ঘুরে এবং উপগ্রহের তথ্য বিশ্লেষণ করে তিনি বলেছিলেন, ২৭ বছরে ৭৬ বর্গকিলোমিটার জমি কমেছে সুন্দরবনের।

তবে বনের জমি কমে আসার বিষয়টি স্বীকার করতে চায় না বন বিভাগ। বন বিভাগের খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো প্রথম আলোকে বলেন, বনের আয়তন কমছে কি না, সে বিষয়ে সহমত বা দ্বিমত পোষণ করা যায় না। সুন্দরবনের ভেতরে নদীভাঙন স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বনের মধ্যে কোথাও বড় কোনো অঞ্চল নদীতে বিলীন হয়েছে কি না, তা মাঠপর্যায়ের পর্যবেক্ষণে দেখা যায়নি।

কেন বনের জমি কমছে

ভূতত্ত্ববিদেরা বলছেন, বাংলাদেশের কিছু এলাকাসহ সুন্দরবন হচ্ছে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার ‘অ্যাকটিভ ডেলটা’ অঞ্চলে। অর্থাৎ এই বদ্বীপ এলাকায় ভূগঠনপ্রক্রিয়া শেষ হয়নি। এই অঞ্চলের ভূমি এখনো ভাঙা-গড়ার মধ্যে আছে।

সুন্দরবনের মধ্যে ছোট-বড় অসংখ্য নদী ও খাল রয়েছে। জালের মতো বিছানো এসব খাল-নদীর মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার। এসব নদী-খাল দিনে দুবার জোয়ারের পানিতে ভরে যায়, দুবার ভাটায় পানি নেমে যায়। জোয়ার–ভাটার কারণে নদীর পাড় ভাঙে-গড়ে। তবে গত ১০০ বছরে দেখা গেছে, ভাঙনই বেশি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউটের একদল গবেষক ২০১৭ সালে বলেছিলেন, নদীভাঙনের কারণে বনের জমি কমছে।

বৈরিতার মুখে সুন্দরবন

স্বাদু ও লোনাপানি মিলিত হয় এমন ভূমিতে সুন্দরবনের মতো বন গড়ে ওঠে। বনবিজ্ঞানীরা এ ধরনের বনের নাম দিয়েছেন ম্যানগ্রোভ। বিশ্বের আরও বেশ কিছু সমুদ্র উপকূলে ম্যানগ্রোভ আছে। কিন্তু সুন্দরবনের মতো এত বড় ম্যানগ্রোভ বন বিশ্বের আর কোথাও নেই।

শুধু আয়তনের কারণে নয়, জীববৈচিত্র্যের জন্যও সুন্দরবন অনন্য। বিশ্বব্যাংকের ২০২০ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বনে ৫২৮ প্রজাতির বৃক্ষ ও লতাগুল্ম আছে, আছে ৩০০ প্রজাতির পাখি। ৫৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী এবং ৯ প্রজাতির উভচর প্রাণী সুন্দরবনে চরে বেড়ায়। সুন্দরবনের নদী-খালে ২৫০ প্রজাতির মাছ আছে। আছে বহু প্রজাতির কীটপতঙ্গ, কাঁকড়া, শামুক-ঝিনুক। আছে নানা ধরনের ছত্রাক, শেওলা।

এই প্রাণবৈচিত্র্যপূর্ণ সুন্দরবনের ওপর চাপ বাড়ছে। চার দশক ধরে সুন্দরবনে উত্তর থেকে আসা স্বাদুপানির পরিমাণ কমেছে, লোনাপানির প্রবাহ বেড়েছে। এর ফলে লোনাপানি–সহিষ্ণু গাছ ও লতাগুল্মের প্রজাতি টিকে থাকার সম্ভাবনা বেড়েছে। কমেছে বা ঝুঁকিতে পড়েছে স্বাদুপানি বা ব্রাকিস ওয়াটার–সহিষ্ণু প্রজাতিগুলো।

আরও বেশ কিছু কারণ সুন্দরবনকে চাপে ফেলেছে। সাম্প্রতিককালে বেশি আলোচনা হচ্ছে রামপাল কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র ঘিরে। উৎপাদন শুরু হলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের পোড়া কয়লার ছাই সুন্দরবনের ক্ষতি করবে বলে পরিবেশবাদীরা কয়েক বছর ধরে অভিযোগ করে আসছেন। এ ছাড়া মোংলা সমুদ্রবন্দরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে প্রায় ১০০ শিল্পকারখানা। এসব কারখানার বর্জ্য পশুর নদ হয়ে সুন্দরবনে পৌঁছায়। বড় বড় জাহাজ ছাড়াও অসংখ্য নৌযান নিয়মিত যাতায়াত করে পশুর নদ দিয়ে। জাহাজসহ সব নৌযান চলাচল করে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে। এদের উচ্চ শব্দ বনের নিস্তব্ধতা ভাঙে, এদের চোখ–ঝলসানো আলো পশুপাখির রাতের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায়।

এ ছাড়া সুন্দরবনে আছে শিকারির উৎপাত। গত সপ্তাহে মোংলা ইপিজেড এলাকা থেকে একটি চিত্রা হরিণ উদ্ধার করেছে কর্তৃপক্ষ। পথ ভুলে বা নদী পার হয়ে জনবহুল ইপিজেড এলাকায় হরিণের পক্ষে আসা সম্ভব নয়। অনেকে সন্দেহ করেন, পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারায় পাচারকারীরা হরিণটি ওই এলাকায় ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।

মাছ ধরার নামে জলজ প্রাণী নিধনও চলছে। গত কয়েক দশকে জেলেরা ছোট ছোট খালে বিষ ঢেলে মাছ ধরেন বলে গণমাধ্যমকর্মীরা সংবাদ প্রকাশ করছেন। এতে মাছের সঙ্গে অন্যান্য জলজ প্রাণী মারা যায়। অন্যদিকে মাছ ধরার জন্য সুন্দরবনের শেষ সীমানায় দুবলার চর এলাকায় প্রায় ২০ হাজার জেলে প্রতিবছর অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত অস্থায়ী বসতি গড়ে তোলেন। এই বসতিও সুন্দরবনের জন্য হুমকি।

জলবায়ুপরিবর্তনের প্রভাব

মানুষের এসব কর্মকাণ্ড ছাড়াও সুন্দরবনে আঘাত হানে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস। এসব ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে শুধু যে গাছের ক্ষতি হয় তা নয়, প্রচুর পশুপাখির প্রাণহানি ঘটে। পরিবেশবিজ্ঞানীরা বলছেন, বছর বছর ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সংখ্যা বাড়ছে। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির অর্থ উপকূলে জোয়ারের পানির পরিমাণ বৃদ্ধি। এই পানি লোনা। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনটি বলছে, লোনাপানির প্রবাহ বাড়ছে সুন্দরবনে।

তবে এসব কারণে সুন্দরবন দুর্বল হচ্ছে বা বনের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে—এমন বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন বন বিভাগের খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো। তিনি বলেন, ২০১৮ সালে সর্বশেষ জরিপে সুন্দরবনে ১১৪টি বাঘ পাওয়া গিয়েছিল। বাঘের সংখ্যা ঠিক আছে কি না, বেড়েছে কি না, অন্যান্য প্রাণী, পশুপাখি বেড়েছে কি না, তা জানার জন্য আবার জরিপ হওয়া দরকার।

প্রকৃতিবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএনের ২০১৫ সালের তথ্য উদ্ধৃত করে বিশ্বব্যাংক বলছে, বাংলাদেশে সুন্দরবন থেকে ১৯ প্রজাতির পাখি, ১১ ধরনের স্তন্যপায়ী ও এক প্রজাতির সরীসৃপ আঞ্চলিকভাবে বিলুপ্ত হয়েছে। বিলুপ্তির ঝুঁকিতে থাকা মাছ ও গাছের প্রজাতির বর্ণনাও তাতে আছে।

২০১৭ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউটের গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৮৯ সালে সুন্দরবনে ঘন বন ছিল ৬৩ শতাংশ। ২০১৪ সালে তা কমে হয় ৩৮ শতাংশ। গবেষণায় বন দুর্বল হওয়ার আরও নানা তথ্য আছে।

বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় যুক্ত ছিলেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, শত শত বছর ধরে সুন্দরবন ঝড়–ঝঞ্ঝা থেকে মানুষকে রক্ষা করে চলেছে। বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে ও অর্থনীতিতে এর অবদান অপরিসীম। নানা কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব তীব্র হতে চলেছে সুন্দরবনে। সুন্দরবনকে সহায়তার সব ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে।

Archive Calendar

Mon Tue Wed Thu Fri Sat Sun
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
252627282930