বিচারপ্রার্থীর শেষ আশ্রয়স্থল আদালত। প্রতিদিন বিচারপ্রার্থীসহ দেশের অসংখ্য মানুষ এখানে আসেন। নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় ভোগান্তিতে পড়তে হয় বিচারপ্রার্থীদের। গত ১৫ বছরে বিচারিক আদালত ও উচ্চ আদালতে নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। আদালতের এসব অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। গত ২১শে সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতির অভিভাষণ অনুষ্ঠানে সারা দেশের বিচারকরা যোগ দেন। অভিভাষণে প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগে যেকোনো প্রকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের স্পেশাল অফিসার ও মুখপাত্র মোয়াজ্জেম হোছাইন মানবজমিনকে বলেন, বিচারপ্রার্থী জনগণের সেবা সহজীকরণ এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রধান বিচারপতি ১২ দফা নির্দেশনা ও হেল্পলাইন চালু করেছেন। উভয় বিভাগের রেজিস্ট্রার বরাবর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণের কাছে সময়ে সময়ে মাসিক মূল্যায়ন প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
১২ দফা নির্দেশনা
বিচারপ্রার্থী জনগণের সেবা সহজীকরণ এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রধান বিচারপতি ১২ দফা নির্দেশনা দেন। দায়িত্ব পালনে কোড অব কন্ডাক্ট যথাযথভাবে পালন; দায়িত্ব পালনকালে আর্থিক লেনদেন সম্পূর্ণভাবে বর্জন; সেবা গ্রহীতাকে দ্রুত সময়ের মধ্যে সেবা নিশ্চিত করা; সেবা প্রদানের সময় কোনো বিলম্ব সম্পূর্ণ পরিত্যাজ্য করতে হবে; সেবা গ্রহীতাদের কোনো প্রকার হয়রানি না করা, সুপ্রিম কোর্টের কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণকে সেবা গ্রহীতাদের সঙ্গে সহানুভূতিশীল আচরণ; প্রতিটি শাখায় প্রতিদিনের কাজ প্রতিদিন সম্পন্ন করা এবং কোনো কাজ পেন্ডিং না রাখা; প্রত্যেক শাখার সহকারী রেজিস্ট্রার এবং ডেপুটি রেজিস্ট্রারগণকে তাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত শাখাসমূহে প্রতিদিন সরজমিন মনিটর; প্রত্যেক শাখার সহকারী রেজিস্ট্রার এবং ডেপুটি রেজিস্ট্রারগণ তাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত শাখার কার্যক্রম সম্পর্কে স্ব স্ব অতিরিক্ত রেজিস্ট্রারগণকে নিয়মিত অবহিত করা; প্রতি চার সপ্তাহ পর পর অতিরিক্ত রেজিস্ট্রারগণ মনিটরিং কার্যক্রমের প্রতিক্রিয়া ও ফলাফল আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রারের কাছে রিপোর্ট করার বিধান চালু করেছেন। যদি কোনো কর্মকর্তা/কর্মচারী আচরণবিধি নির্দেশনার ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোনো সেবা গ্রহীতাকে হয়রানি করেন বা আর্থিক লেনদেন করেন তাহলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এ ছাড়া এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নে সুপ্রিম কোর্টের কর্মকর্তা-কর্মচারীগণকে ৮টি বিষয় অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। (ক) প্রধান বিচারপতির দেয়া ১২ (বার) দফা নির্দেশনার পরিপূর্ণ বাস্তবায়নে সচেষ্ট থাকা; বিচারপ্রার্থী জনগণের সেবা পাওয়ার অধিকার বিষয়ে সচেতন; সেবার বিনিময়ে কোনো লেনদেন বা আর্থিক সুবিধা গ্রহণ হতে বিরত থাকবেন, প্রত্যেক শাখার সম্মুখে প্রকাশ্য স্থানে সেবা গ্রহীতাদের অধিকার সংক্রান্ত সিটিজেন চার্টার প্রদর্শনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট সহকারী রেজিস্ট্রারগণ গ্রহণ করবেন। প্রত্যেক শাখার সম্মুখ স্থানে অভিযোগ/পরামর্শ বক্স স্থাপন করা হবে। সংশ্লিষ্ট সহকারী রেজিস্ট্রারগণ তার অধীন প্রত্যেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর নামফলক/অফিস পরিচয়পত্র (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) স্থাপন ও প্রদর্শনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন; যাতে সেবাগ্রহীতাগণ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীকে শনাক্ত করতে পারেন। প্রধান বিচারপতি মহোদয়ের নির্দেশনাসমূহ বিষয়ে গৃহীত পদক্ষেপ সংক্রান্তে প্রতিদিনের অগ্রগতি প্রতিবেদন এবং মাসিক মূল্যায়ন প্রতিবেদন উভয় বিভাগের রেজিস্ট্রার বরাবর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণের কাছে সময়ে সময়ে দাখিল করতে হবে।
হেল্পলাইন চালু
সুপ্রিম কোর্টে কোনো বিচারপ্রার্থী বা সেবাগ্রহীতা সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রির কোনো শাখায় সেবা গ্রহণে কোনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হলে বা সেবা গ্রহণ সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে অসুবিধার মুখোমুখি হলে সেবাগ্রহীতাকে সহায়তা করার জন্য একটি হেল্পলাইন নম্বর চালু করা হয়েছে। বুধবার বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে এ হেল্পলাইন চালু করা হয়। +৮৮ ০১৩১৬১৫৪২১৬- এই নম্বরে যোগাযোগ করে পরামর্শ গ্রহণ করা যাবে। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রির একজন কর্মকর্তা হেল্পলাইন পরিচালনা করবেন এবং সেবাগ্রহীতাকে প্রয়োজনীয় সাহায্য প্রদান করবেন। সরকারি ছুটির দিন ব্যতীত প্রতি রোববার হতে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে বেলা ৪টা পর্যন্ত হেল্পলাইন সার্ভিস চালু থাকবে।
অভিভাষণে প্রধান বিচারপতি দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করে বিচারকদের উদ্দেশ্যে বলেন, ব্যক্তি পর্যায়ে একজন বিচারকের দুর্নীতি সমগ্র বিচার বিভাগের উপরেই কালিমা লেপন করে। এমনকি আদালতের একজন সহায়ক কর্মচারী কিংবা আইনজীবী সহকারীও যদি দুর্নীতি করেন, সাধারণ জনগণ সাদা চোখে সেটিকে বিচার বিভাগের অবক্ষয় হিসেবেই গণ্য করে। তাই বিচারাঙ্গন হতে যেকোনো প্রকার দুর্নীতি বিলোপ করতে হবে। যদি দুর্নীতি প্রতিরোধে এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে কোনো প্রতিষ্ঠান প্রধান, তথা জেলা জজ, কিংবা চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারক ব্যর্থ হন তবে সেটিকে তার পেশাগত অযোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হবে। দুর্নীতিগ্রস্ত অফিসার বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এ ছাড়া আমাদের উচ্চ আদালত সম্পর্কেও বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যায়। অনেক সময়েই সুপ্রিম কোর্টের এফিডেভিট শাখা, ডেসপাস শাখা, নকল শাখার বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে নেতিবাচক খবর আমার কানে আসে। আমি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করতে চাই, এ ধরনের কোনো অনিয়ম আর বরদাস্ত করা হবে না।
আপনার মতামত লিখুন :