টেলিগ্রাম রিপোর্ট : মাহাথির মোহাম্মদ আধুনিক মালয়েশিয়া গড়ার কারিগর। তাকে দেশবাসী সম্মানের সঙ্গে মাথায় রাখেন। সেই তিনিই কিনা জাতীয় নির্বাচনে পরাজিত হলেন! শুধু পরাজিতই নয়, একেবারে জামানত হারিয়েছেন! অবিশ্বাস্য মনে হলেও খবরটি সত্য। তার মতো ব্যক্তির জন্য এটা লজ্জার। অপমানের। এর মধ্যদিয়ে ইতি ঘটতে পারে তার রাজনৈতিক জীবনের ক্যারিয়ার। দীর্ঘ সময় মালয়েশিয়া শাসন করেছেন তিনি। জীবনের শেষ বয়সে এসে আরও একবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। এখন তার বয়স ৯৭ বছর। এই বয়সে তার অবসরে যাওয়ার কথা।
কিন্তু রাজনীতির নেশায় তিনি শনিবারের পার্লামেন্ট নির্বাচনে অংশ নিয়ে নিজের আসনে চতুর্থ হয়েছেন। দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন মাহাথির অবসর না নিয়ে কি ভুল করেছেন! অনেক বিশ্লেষক মনে করেন- হ্যাঁ। সম্মানের সঙ্গে তিনি অবসরে চলে গেলে এমন অপমানের মুখে পড়তে হতো না। সারা জীবন তিনি মাথা উঁচু করে চলতে পারতেন। কিন্তু ক্ষমতার মোহ মানুষকে অন্ধ করে দেয়। নিজেকে চিরস্থায়ী মনে করে। এর পরিণতি এমনই হয়। নির্বাচনে কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। ফলে মালয়েশিয়ায় এবার নতুন সরকার হতে যাচ্ছে জোটের ভিত্তিতে। ফলে সেই পার্লামেন্ট হবে ঝুলন্ত। ওদিকে দেশটির রাজা সোমবার স্থানীয় সময় দুপুর ২টার মধ্যে দলগুলোকে সরকার গঠনের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন। এ অবস্থায় কিংমেকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে বরিসান ন্যাশনাল দলকে।
এ দলটি বিশেষভাবে উমনো নামে পরিচিত। সবচেয়ে বড় দুটি জোট হলো পাকাতান হারাপান এবং পেরিকেতান ন্যাশনাল। তারা পেয়েছে যথাক্রমে ৮২ ও ৭৩ আসন। ২২২ আসনের মধ্যে যদি পাকাতান ১১২ আসন পেয়ে যায় তাহলে তাদেরকে সহায়তা করবে না বরিসান দল। সে অবস্থায় পিকেআরের প্রেসিডেন্ট ও সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম হতে পারেন মালয়েশিয়ার ১০ম প্রধানমন্ত্রী। অন্যদিকে যদি পেরিকাতান ওই ম্যাজিক নাম্বার (১১২) সংগ্রহ করতে পারে তাহলে এর চেয়ারম্যান এবং পারতি প্রিভুমি বেরসাতু মালয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট মুহিদ্দিন ইয়াসিন আবারো প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন।
৫৩ বছরের মধ্যে এই পরাজয় মাহাথির মোহাম্মদের জন্য সবচেয়ে বড় এবং প্রথম পরাজয়। তিনি মালয়েশিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের অবকাশযাপন বিষয়ক দ্বীপ ল্যাঙ্কাবি থেকে নির্বাচন করেন। ২০১৮ সালে এই আসনে তিনি ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বিজয়ী হয়েছিলেন। রাজধানী কুয়ালালামপুরের বাইরে থেকে আল জাজিরার সাংবাদিক ফ্লোরেন্স লুই বলছেন, এটা এক বড় বিস্ময়ের ব্যাপার যে, মাহাথির মোহাম্মদ পরাজিত হয়েছেন। তারচেয়ে বড় কথা হলো তার মতো দর্শনীয় ওজনদার রাজনীতিকের এমন শোচনীয় পরাজয়। জামানত হারানোর পাশাপাশি তিনি মোট ভোটের আট ভাগেরও বেশি ভোট পেতে সক্ষম হননি। তার দলও একটি আসনে জিততে সক্ষম হয়নি।
শনিবার (১৯শে নভেম্বর) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশটিতে ভোটগ্রহণ হয়। আল জাজিরা আরও বলেছে, নির্বাচন কমিশন বলেছে, লাংকাউইয়ের হলিডে রিসোর্ট দ্বীপে নিজের দীর্ঘদিনের নির্বাচনী এলাকায় পাঁচমুখী লড়াইয়ে চতুর্থ স্থান লাভ করেছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। অথচ ১৯৮১ সাল থেকে ২২ বছর এ দেশটিতে তিনি একটানা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এ সময়ে তিনি মালয়েশিয়াকে নিজের মতো করে সাজিয়েছেন। তার অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটিয়েছেন। ফলে বিশ্বের বিনিয়োগ আকৃষ্ট হয়েছে মালয়েশিয়ায়। ২০০৩ সালে আকস্মিক রাজনীতি থেকে অবসরে যাওয়ার ঘোষণা দেন।
কিন্তু ক্ষমতাসীন বারিসান ন্যাশনাল জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের রাষ্ট্রীয় তহবিল ১এমডিবি থেকে কয়েক শত কোটি ডলার কেলেঙ্কারির পর আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হন মাহাথির। জোট বাঁধেন তারই সাবেক ডেপুটি ও একসময়কার বিরোধী আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে। তারা জোটবদ্ধ হয়ে নাজিব রাজাককে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেন। ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে সফল হন তিনি। ৯৩তম জন্মদিনের দুই মাস পরে এ ঘটনা ঘটে। তিনি সফল হন। আবার প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে পদত্যাগ করেন। তার বয়স হয়েছে। শতবর্ষ ছুঁই ছুঁই করছেন। চলাচলের গতি ধীর হয়েছে। কিন্তু তাকে দেখতে সুস্থই মনে হয়। এবার তিনি নিজের দল পেজুয়াং পার্টির ব্যানারে নির্বাচন করেন। তার অবসর নেয়া উচিত- এমন পরামর্শ শুনে হেসেছিলেন। নির্বাচনের আগে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, জয়ী হওয়ার ভালো সম্ভাবনা আছে তার। মাহাথির বলেছিলেন- আমি এখনো আপনাদের পাশে আছি। আপনাদের সঙ্গে কথা বলছি। চিন্তা করছি। যৌক্তিক উত্তর দিচ্ছি।
তবে তার ও তার দলের ভরাডুবির পর ইউনিভার্সিটি অব নটিংহ্যাম মালয়েশিয়ার ব্রিজেত ওয়েলশ বলেন- মাহাথিরের সময় শেষ হয়ে গেছে।
ডেডলাইন দুপুর ২টা: পার্লামেন্ট নির্বাচনে কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোকে সরকার গঠনের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন মালয়েশিয়ার রাজা। এ সময় শেষ হবে সোমবার স্থানীয় সময় দুপুর ২টায়। নতুন সরকার গঠন করে একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রার্থীর নাম জানাতে বলা হয়েছে রাজপ্রাসাদ থেকে। এ খবর দিয়েছে অনলাইন দ্য স্টার। রয়েল হাউজহোল্ড কম্পট্রোলার আহমাদ ফাদিল শামসুদ্দিন বলেছেন, দেওয়ান রাকায়েত নামে পরিচিত পার্লামেন্টের স্পিকার আজহার আজিজান হারুনকে রাজনৈতিক দলগুলো এবং জোটগুলোর সঙ্গে শলাপরামর্শ করার দায়িত্ব দিয়েছেন রাজা। যারা বেশি আসন পেয়েছেন তাদেরকে সরকার গঠনের জন্য এ সময় দেয়া হয়েছে। রোববার ইস্যু করা এক বিবৃতিতে আহমাদ ফাদিল বলেন, ১৯শে নভেম্বর অনুষ্ঠিত ১৫তম জাতীয় নির্বাচনের সরকারি ফল গ্রহণ করেছে রাজপ্রাসাদ ইস্তানা নেগারা। রোববার স্থানীয় সময় দুপুর ১টা ১৫ মিনিটে তারা নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে এই ফল হাতে পায়।
তিনি আরও বলেন, নির্বাচন কমিশনের চেয়ারম্যান আবদুল গণি সালেহ পরিষ্কারভাবে তার ডকুমেন্টে বলেছেন, নতুন সরকার গঠন করার মতো একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি কোনো রাজনৈতিক দল। তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো এবং জোটের প্রধানদের সঙ্গে আলোচনা করতে আজহারকে অনুরোধ করেছেন ইয়াং ডি-পারতুয়ান আগং আল সুলতান আবদুল্লাহ রিয়াতুদ্দিন আল মুস্তাফা বিল্লাহ শাহ। দলীয় এসব প্রধানের সঙ্গে আজহার কথা বলে ইস্তানা নেগারাকে জানাবেন কোন কোন রাজনৈতিক দল জোট করে সরকার গঠন করবে। এরপর ওই জোটকে বলা হবে একজন এমপির নাম প্রস্তাব করতে, যিনি দেওয়ান রাকায়েতে সংখ্যাগরিষ্ঠ আস্থা অর্জন করে প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন সোমবার দুপুর ২টার মধ্যে। তিনি আরও বলেন, জনগণ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধানদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া মেনে নিয়ে এর প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে পরামর্শ দিয়েছেন রাজা। নির্বাচনের ফলকে শান্তভাবে মেনে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। দেশের স্থিতিশীলতার জন্য খোলা মনে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
আপনার মতামত লিখুন :