ঢাকা ০৪ অক্টোবর ২০২৪, শুক্রবার, ১৯শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
২৯শে রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

মওলানা ভাসানীর ১৯৭০-এর নির্বাচন বর্জন ছিল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দূরদর্শী সিদ্ধান্ত


টেলিগ্রাম রিপোর্ট প্রকাশের সময় : নভেম্বর ২৪, ২০২২, ৮:০৯ অপরাহ্ণ / ২৭২২০ ০
মওলানা ভাসানীর ১৯৭০-এর নির্বাচন বর্জন ছিল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দূরদর্শী সিদ্ধান্ত
আতিকুর রহমান সালু

মূল কথায় যাওয়ার পূর্বে মওলানা ভাসানীর কাগমারী সম্মেলন সম্পর্কে কিছু বলা প্রয়োজন। টাঙ্গাইল জেলার সন্তোষ ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত কাগমারীতে ১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারী ৮, ৯ ও ১০ তারিখে অনুষ্ঠিত হয় এক বিশাল সম্মেলন। উক্ত সম্মেলন ডাকা হয়েছিল “শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক” সম্মেলনের নামে। চুড়ান্ত বিশ্লেষণে উক্ত সম্মেলন এতদঅঞ্চলে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিকাশ ও বাঙালী জাতীয়তাবাদের উন্মেষে রাখে এক অসাধারণ ভূমিকা।
এই সম্মেলনই ইতিহাসে ‘ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলন’ নামে খ্যাত’। উক্ত সম্মেলনে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, পূর্ব পাকিস্তানের মূখ্যমন্ত্রী প্রয়াত আতোয়ার রহমান ও শেখ মুজিবর রহমান সহ কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সাংসদ, মন্ত্রী এবং দেশ-বিদেশের বরেন্য ব্যক্তিত্ব, রাজনীতিক, শিক্ষাবিদ, কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক সহ লক্ষ লোকের সমাগম হয়। আমার মরহুম পিতা নূরুর রহমান খান ইউসুফজাই ছিলেন তৎকালীন অবিভক্ত ভারতের বঙ্গীয় শাসনতান্ত্রিক পরিষদের সদস্য ও মওলানা ভাসানীর পৃষ্টপোষক। যিনি বরাবরই মওলানা ভাসানীর দেশ প্রেমের প্রশংসা করতেন। সম্মেলনের দিন পিতার হাত ধরে সেই সম্মেলনে যোগদানের সুযোগ হয়। সে এক হৈ-হৈ কান্ড ও রৈ-রৈ ব্যাপার। সম্মেলনে আগমনের পথে পথে নির্মিত হয় অসংখ্য তোরণ।

মওলানা মোহাম্মদ আলী তোরণ, মওলানা শওকত আলী তোরণ, মহাত্মা গান্ধীতোরণ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ তোরণ, শহীদ তীতুমীর তোরণ সহ অসংখ্য তোরণ।
এছাড়া ছিল অসংখ্য দোকান পাট, চুড়ি, শাড়ী, লুঙ্গী, গামছা, চায়ের স্টল ও খাবারের দোকান। এই সম্মেলনে বিশাল-বিশাল ডেকচী করে চাল-ডাল, গোস্ত ও সবজি দিয়ে রান্না হত সুস্বাদু খিচুরী। যা হুজুর ভাসানীর খিচুরী নামে এখনও বিখ্যাত। কিন্তু মজার ব্যাপার এই যে, এত তোরণ তার মধ্যে হুজুর ভাসানীর নামে কোন তোরণ ছিলো না। কারণ হুজুরের নিষেধ ছিল তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর নামে কোন তোরণ নির্মাণ করা যাবে না। ভারতের ধুবরি, আসাম, ভাসান চরে, টাঙ্গাইলের, সন্তোষের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কাগমারী মওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়, বগুড়ার মহীপুর, পাঁচবিবিতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন যত মসজিদ, মাদ্রাসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তার কোনটিতেই তিনি প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নিজের নাম ব্যবহার করেননি। যথার্থ অর্থেই তিনি ছিলেন নির্লোভ ও দূর্লভ এক ব্যক্তিত্বের অধিকারী।
১৯৫৭ সালে টাঙ্গাইলের যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত ছিলো না। ছিলো না কোনো ইলেকট্রিসিটির ব্যবস্থা। সেই অবস্থায় কাগমারীর মতো অজপাড়াগায়ে এই ধরনের সম্মেলনের আয়োজন করা সহজ সাধ্য ছিলো না। ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলন করে হুজুর ভাসানী সেই অসাধ্য সাধনই করেছেন। এই সম্মেলনেই তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান অধূনা বাংলাদেশের এই অঞ্চলের মানুষের উপর, শোষন, জুলুম ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে পাকিস্তানী বর্বর শাসক গোষ্ঠিকে বলেছিলেন ‘আসসালামো আলাইকুম।’ সেই বক্তৃতা এখনও কানে বাজে।

পশ্চিম পাকিস্তানের বিজাতীয় শাসন ও শোষনের বিরুদ্ধে তিনি ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনের জনসভায় বলেন, ‘অনেক সংগ্রাম-আন্দোলন করে ও রক্ত দিয়ে বৃটিশকে তাড়িয়ে যে পাকিস্তান আমরা আনলাম তার মূল উদ্দেশ্যই ছিল এই অঞ্চলের মানুষ তাদের দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্তি পাবে, পাবে অর্থনৈতিক মুক্তি, কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয়- আমাদের এই অঞ্চলের মানুষকে তোমরা শায়ত্ব-শাসন দেয়া তো দূরের কথা ১৯৫২ সালে আমাদের মাতৃভাষা বাংলাভাষার উপর আক্রমণ করলা, ছাত্র-পাবলিক হত্যা করলা। ১৯৫৪ সনের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়েও মন্ত্রিসভা গঠন করার পরপরই ৯২ ‘ক’ ধারা জারী করে পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দিলা।

আমাদের স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার এইভাবে যদি ক্ষুণ্ন করতে থাক এবং এই শোষন-জুলুম ও বেইনসাফী কাজ কারবার যদি চলতে থাকে তবে জেনে রাখ, আমি তোমাদের ‘আসসালামো আলাইকুম’ দিতে বাধ্য হব। সে ছিল এক অসাধারণ বক্তৃতা।

১৯৭০ সালের ১২ নম্বেভরের ঘূর্ণিঝড়ে দক্ষিণাঞ্চলে ১৫ লক্ষ আদম সন্তানের মৃত্যু হয়। হুজুর মৃত্যুশয্যা থেকে পরম করুণাময়ের অশেষ কৃপায় কিছুটা সুস্থ্য হয়ে ঘূর্ণিদূর্গত এলাকা সফর করেন। ঐ সফরে আমিও তার সাথে ছিলাম। পাকিস্তানি জান্তারা আগে ভাগে কোনো সতর্কীকরণ বার্তা প্রদান করে নাই। ঝড়ের পরেও দেখতে কেউ আসে নাই।

হুজুর উপদধুত এলাকা সফর করে ১৯৭০ এর ৪ঠা ডিসেম্বর আবার ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে করেন এক বিশাল জনসভা। সেই জনসভায় মওলানা ভাসানী তার বক্তৃতায় পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর উদ্দেশ্যে বলেন, ‘১৯৫৭ সালে আজ থেকে ১৩ বছর পূর্বে কাগমারী সম্মেলনে আমি বলেছিলাম যে, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের প্রতি তোমাদের শোষণ, জুলম ও বেইনসাফী কার্যকলাপ বন্ধ না হলে আমি ‘আসসালামো আলাইকুম’ দিতে বাধ্য হব।

সর্বনাশা ঝড়ে লক্ষ-লক্ষ লোক মরলো, তোমরা কেউ দেখতে আসলে না। ঝড়ের আগাম খবর দিলা না। গাছের ডালে, ঘরের চালে, ক্ষেতে খামারে দেখে আসলাম শুধু লাশ আর লাশ ও শতশত মৃত গবাদী পশু। মানুষের ঘর-বাড়ি নাই, ঝড়ে সব শেষ হয়ে গেছে। এই অবস্থায় আজ আমি চুড়ান্তভাবে তোমাদের জানাচ্ছি ‘আসসালমো আলাইকুম’।
বলছি ‘লাকুম দ্বীনওকুম অলিয়াদীন’- তোমাদের সঙ্গে আর আমাদের সমাজ জামাত করা যাবে না। এরপর তিনি বলেন, ‘আজ তাই একদফা, স্বাধীনতার দফা আমি উত্থাপন করছি। এই বক্তৃতা আমার মতে হুজুর ভাসানীর সর্বশ্রেষ্ট বক্তৃতা। আমি সেদিন মঞ্চে উপবিষ্ট ছিলাম। দেখি পাশেই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে প্রখ্যাত কবি প্রয়াত শামসুর রাহমান বক্তৃতা শুনছেন। মওলানা ভাসানীর বক্তৃতা শুনে জনসভায় উপস্থিত অনেককেই হুঁ-হুঁ করে কাঁদতে দেখেছি। এই বক্তৃতা শুনেই কবি শামসুর রাহমান লেখেন, হুজুরকে নিয়ে তাঁর ঐতিহাসিক ‘সফেদ পাঞ্জাবী’ কবিতা।
১৯৬৯ সনের ছাত্রদের ঐতিহাসিক ১১ দফা আন্দোলন ও গণঅভ্যূত্থানের কথা সর্বজন বিদিত। সেই সভায় আগরতলা ষরযন্ত্র মামলায় বন্দী শেখ মুজিবকে মুক্ত করার জন্যে পাকিস্তানিদের উদ্দেশ্যে মওলানা ভাসানীর বজ্রনিঘোষ ঘোষণা এখনও কানে বাজে। অবিলম্বে শেখ মুজিবকে মুক্তি না দিলে জেলের তালা ভেঙ্গে তাকে মুক্ত করা হবে। এই ঘোষণার পরপরই শেখ মুজিব মুক্তি লাভ করেন। ১৯৭০ এর নির্বাচন মওলানা ভাসানী বর্জন করেন। তিনি জেনে-বুঝেই এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি তখন সংকল্পবদ্ধ ছিলেন পাকিস্তান ভেঙ্গে এই অঞ্চলের মানুষের নিজস্ব স্বাধীন আবাস ভূমি প্রতিষ্ঠার জন্যে। তিনি জানতেন, নির্বাচনে ভাসানী ন্যাপ, ২০/৫০টি সিট পেলে আর পাকিস্তান ভাঙ্গা সহজ হবে না।
অনেক সাহস নিয়ে আমি সেদিন তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম হুজুর আওয়ামী লীগকে ‘ব্ল্যাঙ্ক’ চেক দিলেন। হুজুর একটু রাগতভাবে বললেন, ‘বেশি বোঝ, পরক্ষণেই মৃদু হেসে বললেন, ‘তোমরা না দেশ স্বাধীন করবা, বিপ্লব করবা, যাও কাজ কর, কাজ কর, এখন কাজের সময়।’

আমি এখনও ভেবে অবাক হই যে, মওলানা ভাসানী জেনে বুঝেই পাকিস্তান ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত নিয়েই নির্বাচন বর্জনের ডাক দিয়ে এই অঞ্চলের মানুষ যাতে স্বাধীন আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আগুয়ান হয় এই জন্যেই কৌশুলী সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি কি যথার্থ অর্থেই ভবিষ্যত দ্রষ্টা ছিলেন?

দলকানা ও অর্বাচীন যারা তারা অনেক সময় মওলানা ভাসানীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ও জিয়ার তুলনা করতে উদ্যত হয়। ইতিহাসের সত্য এই যে, শত বৈরীতা স্বত্বেও ভাসানী-মুজিবের সম্পর্ক ছিল পিতা-পুত্রের। আর জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ও তার উপস্থিতিতেই টাঙ্গাইলের সন্তোষে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীকে সমাহিত করা হয়। তাঁর স্নেহধন্য হিসেবে এবং তাঁকে কাছ থেকে দেখার যে সৌভাগ্য হয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে বলবো যে, ভাসানীর তুলনা ভাসানী নিজেই। মরেও তিনি অমর তার কর্মে। মৃত ভাসানীর চেয়ে জীবিত ভাসানী অনেক বেশি শক্তিশালী। তিনি আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস। মৃত্যুর ৬ মাস পূর্বে ১৯৭৬ এর ১৬ই মে ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিবাদে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক ফারাক্কা লং মার্চ এখনও আমাদের অনুপ্রেরণা জোগায়। দেয় উৎসাহ উদ্দীপনা। মাথা উঁচু করে কি করে বাঁচতে হয়। আমাদের  স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় মওলানা ভাসানী তাই যুগে যুগে জোগাবে শক্তি-সাহস ও অনুপ্রেরণা।

 সৌজন্যে : দৈনিক মানবজমিন

Archive Calendar

Mon Tue Wed Thu Fri Sat Sun
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
28293031