ঢাকা ০৪ অক্টোবর ২০২৪, শুক্রবার, ১৯শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
২৯শে রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

যে বই নিয়ে যাবে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে মোগল সাম্রাজ্যে


টেলিগ্রাম রিপোর্ট প্রকাশের সময় : ডিসেম্বর ১, ২০২২, ১:০৭ অপরাহ্ণ / ২৭২২০ ০
যে বই নিয়ে যাবে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে মোগল সাম্রাজ্যে

ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের ‘ ট্রাভেলস ইন দ্য মুগল ইম্পায়ার’

বই শুধুমাত্র জ্ঞানের বা ইতিহাসের কোন ধারক বা বাহক নয়, কিছু বই মানুষকে নিয়ে যায় অতীত যুগে। কিন্তু লেখকের দৃষ্টিভঙ্গিতে সে যুগকে আমরা দেখতে পাই। ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের ‘ ট্রাভেলস ইন দ্য মুগল ইম্পায়ার’ বইটি নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে তুলে ধরা হয়েছে মোগল সাম্রাজ্যের সময়কার ভারতের সমাজের একেবারে ভেতরবাড়ি অব্দি’র  ইতিহাস।

 

মনজুরুল হক: ফরাসি চিকিৎসক, পর্যটক ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের ১৬৫৬ সালে ভারতবর্ষে এসে ১৬৬৮ সাল পর্যন্ত মোগল সম্রাটদের ব্যক্তিগত চিকিৎসক হিসাবে কাজ করেছেন । চিকিৎসা তাঁর প্রধান ঝোঁক ছিল না । তিনি ছিলেন বহেমিয়ান পর্যটক । তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কেবল মোগলদের রীতি-নীতি আচার-আচরণ বা ভালো-মন্দ উন্মোচিত হয়নি, তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ভারতবর্ষকে দেখেছেন । দেখেছেন ভারতের সমাজের একেবারে ভেতরবাড়ি অব্দি । সেই দেখা এতটাই সমৃদ্ধ যে বার্নিয়ের দেশে ফিরে মোগল শাসন তথা ভারতের সমাজের চিত্র তুলে ধরে গ্রন্থ প্রকাশ করেন । সেই গ্রন্থটির ইংরেজি অনুবাদ কার্ল মার্কস-এর গোচরে আসলে তিনি ভারত বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং এর পর পরই ‘ভারত প্রসঙ্গ’ নামক গ্রন্থ রচনা করেন ।

বার্নিয়েরের ইংরেজি বইটি বাংলায় অনুবাদ করেন বিনয় ঘোষ । তাঁর অনুবাদ এত নিখুঁত আর মনোরম যে খোদ বার্নিয়ের পড়েও হয়তো এতটা বোধগম্য হতো না ।

…. ইতিহাস লেখার বৈশিষ্ট্যের কারণে বাংলা ভাষায় লেখা ইতিহাসকে দুইভাবে প্রতিভাত করা করা যায় । এটা ঠিক ‘করা’ বোঝায় না, সমাজে এমন একটি ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে । ছোটবেলা থেকেই ইতিহাস বলতে এই অঞ্চলে মোগলদের ইতিহাস বোঝায় । মোগল বীরত্ব, চাকচিক্য, জাঁক-জৌলুস, মোগল আধিপত্যবাদিতা, মহানুভবতা, সমাজ সেবা, অবদান রাখার মতো বিশেষণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয় । এর আগে-পরের সমস্ত ঘটনাবলিও যে ‘ইতিহাস’ সেটা যেন মনে করা হয় না। উপমহাদেশের ইতিহাস বলতেই তাই মোগলদের ইতিহাসই বোঝায় । দু’শ’ বছরের ব্রিটিশ শাসনের বিশাল-ব্যাপ্ত ইতিহাসকে ধরে নেওয়া হয়-‘বর্তমান’ বা ‘সদ্য শেষ হওয়া বর্তমান’ ।

ইতিহাসবিদদের একাংশের মতো; মোগলরা বহিরাগত, এবং তারা ভারতবর্ষে আগ্রাসী হামলা চালিয়ে দেশ-দখল করে সাম্রাজ্য কায়েম করেছিল অর্থ বিবেচনায় এটা ঠিক । মোগলরা ভারতীয় ছিল না । তারা অস্ত্রের বলে বহিরাগত তস্কর হিসাবেই ভারত দখল করে শাসন কায়েম করেছিল, কিন্তু এটাই ইতিহাসের শেষ কথা নয় । ভারতবর্ষ মোগলদের আক্রমণের এবং দখলের আগেও স্বাধীন ছিল না । বিভিন্ন রাজা-বাদশাদের খণ্ড খণ্ড অঞ্চলে রাজত্ব এবং সাম্রাজ্য ছিল ।এভাবে একেবারে প্রাচীন ইতিহাসের সালুক সন্ধান করলে দেখা যাবে ভারতবর্ষ বা এতদাঞ্চল কখনওই স্বশাসিত ছিল না।ভারতের বৈচিত্রপূর্ণ ইতিহাস ঘেঁটেও দেখা যায় ভারতবর্ষ প্রাচীন মধ্যযুগেও পরাধীনই ছিল ।

ভারতের ইতিহাস মূলত খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দ থেকে খ্রিষ্টীয় বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত বিস্তৃত ধরলে একটা বিশাল কাল অতিক্রম করা যায়। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন -মধ্যযুগীয় ও প্রাক-আধুনিক কালের ইতিহাসকেই বোঝানো হয় । ভারতের জ্ঞাত ইতিহাসের সূচনা হয় ৩৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে ১৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের মধ্যবর্তী সময় পর্যন্ত । ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে সিন্ধু সভ্যতার উন্মেষ ও প্রসারের সময় থেকে । পরবর্তীতে হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো যুগের সময়কাল ২৬০০-১৯০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত । খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের সূচনায় এই ব্রোঞ্জযুগীয় সভ্যতার পতন ঘটে । সূচনা হয় লৌহ-নির্ভর বৈদিক যুগের । এই যুগেই সমগ্র গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলে ‘মহাজনপদ’ নামে পরিচিত ১৬টি প্রধান প্রধান রাজ্য-তথা-জনবসতির উত্থান ঘটে । এই জনপদগুলোর অধিকাংশই রাজতান্ত্রিক হলেও এদের মধ্যে ‘লিচ্ছিবি’ ছিল গণতান্ত্রিক । এই জনপদের মধ্যে অন্যতম ছিল মগধ রাজ্য । খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে মগধে জন্মগ্রহণ করেন মহাবীর ও গৌতম বুদ্ধ; পরবর্তীকালে যাঁরা ভারতের জনসাধারণের মধ্যে শ্রমণ ধর্মদর্শন প্রচার করেন ।

এর পরে একাধিক বৈদেশিক শাসনে আওতায় চলে আসে উত্তর-পূর্বের এই অঞ্চল । এগুলোর মধ্যে ৫৪৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ নাগাদ প্রতিষ্ঠিত হখামনি পারসিক সাম্রাজ্য ৩২৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ নাগাদ আলেকজান্ডারের রাজত্বকাল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । এছাড়া পাঞ্জাব ও গান্ধার অঞ্চলে ব্যাকট্রিয়ার প্রথম ডিমেটিয়াস কর্তৃক ১৮৪ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে স্থাপন করেন ইন্দো-গ্রিক রাজ্য । প্রথম মিনান্ডারের আমলে গ্রিকো-বৌদ্ধ যুগে এই রাজ্য বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির চরমে পৌছেছিল ।

খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় ও চতুর্থ শতাব্দীতে মৌর্য সাম্রাজ্যের অধীনে উপমহাদেশে রাজনৈতিক ঐক্য গঠিত হওয়ার কথা জানা যায় । পরবর্তী দশ শতাব্দীকালে একাধিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য ভারতের বিভিন্ন অংশ শাসন করে । চতুর্থ খ্রিষ্টাব্দে উত্তর ভারত পুনরায় ঐক্যবদ্ধ হয় এবং পরবর্তী প্রায় দুই শতাব্দীকাল গুপ্ত সাম্রাজ্যে পর্যন্ত এই ঐক্য বজায় থাকে । এই যুগটি ছিল হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতির পুনর্জাগরণের কাল । ভারতের ইতিহাসে এই যুগ ‘ভারতের সুবর্ণ যুগ’ নামে অভিহিত । এই সময় ও পরবর্তী কয়েক শতাব্দীতে দক্ষিণ ভারতে রাজত্ব করেন চালুক্য, চোল, পাণ্ড্য রাজন্যবর্গ । তাদের রাজত্বকাল দক্ষিণ ভারতের নিজস্ব এক ‘সুবর্ণ যুগের’ জন্ম দেয় । এই সময়ই ভারতীয় সভ্যতা, প্রশাসন, সংস্কৃতি তথা হিন্দু ও বৌদ্ধধর্ম এশিয়ার অধিকাংশ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। ৭৭ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ কেরলের সঙ্গে রোমান সাম্রাজ্যের সামুদ্রিক বাণিজ্যের কথাও জানা যায় ।

৭১২ খ্রিষ্টাব্দে আরব সেনানায়ক মুহাম্মদ বিন কাশিম দক্ষিণ পাঞ্জাবের সিন্ধু ও মুলতান অধিকার করে নিলে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমান শাসনের সূচনা ঘটে । এই অভিযানের ফলে দশম থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ের মধ্য এশিয়া থেকে সংগঠিত একাধিক অভিযানের ভিত্তিভূমি সজ্জিত করে । এরই ফলস্রুতিতে ভারতীয় উপমহাদেশে দিল্লি সুলতানি ও মোগল সাম্রাজ্যের মতো মুসলমানি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় । মোগল শাসনে উপমহাদেশের প্রায় সমগ্র উত্তরাঞ্চলটি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল ।

কৌশলের বিরুদ্ধে পাল্টা কোনো কৌশল গ্রহণ না করায় ক্রমেই মধ্য ভারতের অনেক এলাকা তাদের হাতছাড়া হয়ে যায় । পারস্য সম্রাট নাদির শাহের ভারত অভিযানের পর মোগল সাম্রাজ্যের শক্তি এবং গৌরব অনেকটাই কমে আসে । অনেক সামন্ত শাসকরা স্বাধীনভাবে তাদের রাজ্য শাসন করতে থাকে। যদিও শুধু মুসলিম অভিযাত্রায় নয়, মারাঠা হিন্দু এবং শিখ নেতৃবৃন্দ মোগল সম্রাটকে ভারতের আনুষ্ঠানিক সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসেবে মেনে চলত ।

পরবর্তী দশকে আফগান, শিখ এবং মারাঠারা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে । মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম সাম্রাজ্যের অখণ্ডতা রক্ষা করতে ব্যর্থ চেষ্টা করেন । শেষ পর্যন্ত তাকে বাইরের শক্তির দ্বারস্থ হতে হয়। ১৭৮৪ সালে মারাঠারা দিল্লির সালতানাতের পরিরক্ষাকারি হিসাবে ঘোষিত হয় । দ্বিতীয় অ্যাংলো মারাঠা যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত এই ব্যবস্থা বজায় থাকে । এরপরে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দিল্লির মোগল বংশের পরিরক্ষাকারী হিসেবে আবির্ভূত হয় । তখন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রাক্তন মোগল সাম্রাজ্যের একটি বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করত । ১৮৫৭-৫৮ সালের সিপাহী বিপ্লব ব্যর্থ হলে, ব্রিটিশ সরকার শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহকে সিংহাসনচ্যুত করে এবং রেঙ্গুনে নির্বাসিত করে । সেই সাথে বিলুপ্ত হয় মোগল সাম্রাজ্যের ।

Archive Calendar

Mon Tue Wed Thu Fri Sat Sun
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
28293031