ড. মাহফুজ পারভেজ :-
শীতের প্রাক্কালে যা হয় বাংলাদেশে, এবারও তাই হচ্ছে। প্রতিদিনই রাজনীতি গরম হচ্ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিকভাবেই উত্তপ্ত।
ভয়ের বাতাবরণ ছেড়ে ছোট-বড় দলগুলো মাঠে-ময়দানে সরব। বছরের পর বছর চাপ ও ভীতিতে আক্রান্ত রাজনীতি এখন টপ গিয়ারে। বাংলাদেশের রাজনীতি প্রসঙ্গে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিও বদলে গেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির ফায়দা তুলছে বিরোধী দলগুলো।
সরকারি পক্ষও বসে নেই। নানা কৌশলে আন্দোলনের জোয়ার ঠেকাতে তৎপর তারা। তাদের তরফে পাল্টা কর্মসূচিও দেওয়া হয়েছে। ১০ ডিসেম্বর সামনে রেখে চলছে সরকারি ও বিরোধী পক্ষের প্রস্তুতি আর রাজনৈতিক অগ্রাধিকারের তালিকা।
স্বাভাবিকভাবেই সরকারি পক্ষের অগ্রাধিকার দলীয়ভাবে নির্বাচন করা। বিরোধী পক্ষের অগ্রাধিকার আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে নির্দলীয় নির্বাচনে বাধ্য করা।
উভয়পক্ষের কাছেই চূড়ান্ত লক্ষ্য ‘ক্ষমতায় থাকা’ এবং ‘ক্ষমতায় যাওয়া’। ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রবাহ চলছে ক্ষমতা-কেন্দ্রিক অগ্রাধিকারকে সামনে রেখে।
কিন্তু দলগুলোর এমন অগ্রাধিকার কি বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট ও অচলাবস্থা নিরসনের জন্য যথেষ্ট? এই প্রশ্নটি উত্থাপন করা এখন সবচেয়ে জরুরি। কারণ, ক্ষমতার স্থিতাবস্থা বজায় থাকলে কিংবা ক্ষমতার পালাবদল হলে সব সমস্যার সুরাহা হয়ে যাবে, এমন নিশ্চয়তা কেউ কি দিতে পারবে? পরাজিত পক্ষ কি নির্বাচন ও জয়ীদের মেনে নেবে? অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে স্পষ্ট উত্তর হলো ‘না’। ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সঙ্কট ও অচলাবস্থা থেকেই যাবে। হতাশা ও আশঙ্কার কারণ এটাই।
দুঃখজনক বিষয় হলো, ক্ষমতাসীন ও বিরোধীরা ক্ষমতায় থাকতে ও যেতে যত উৎসুক, রাজনীতির সঙ্কট ও অচলাবস্থা কাটাতে ততটা আগ্রহী নয়। পঞ্চাশ বছরের বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রের মতো রাজনীতিতেও যে কিছু সংস্কার, অদলবদল দরকার, এই বাস্তব সত্যটিই দলগুলোর কেউই স্বীকার করে না। রাজনৈতিক পরিসরের সঙ্গে সিভিল পরিসরকেও যে সংশ্লিষ্ট করা দরকার, তা-ও দলগুলো মানতে চায় না। রাজনীতিকে হয় সরকার, নয় বিরোধী দলের কব্জায় বন্দি বা জিম্মি করে রাখতেই সর্বশক্তি নিয়োগ করছে রাজনীতিতে ক্রিয়াশীল পক্ষগুলো।
কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বায়নের যুগে সুশাসন, মানবাধিকার, আইনের শাসন, জনকল্যাণকে প্রাধান্য দিয়ে দলীয় রাজনীতি অনেকটাই সঙ্কুচিত হয়ে গিয়েছে। গণতন্ত্রও শুধু ‘ভোটের গণতন্ত্র’ বা ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের দাপটের’ বিষয় নেই। অন্তর্ভুক্তিমূলক (ইনক্লুসিভ) গণতন্ত্রের ধারণায় সমাজের সকল অংশকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশীদার রূপে নিয়ে আসা হয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এসব সময়োপযোগী সংস্কার করার কথা কি কেউ বলছে? দলীয় দ্বন্দ্ব-সংঘাতে বিদীর্ণ রাজনীতির দুষ্টচক্র ভাঙার কথা কি কেউ ভাবছে? ক্ষমতা-কেন্দ্রিক দলীয় স্বার্থচিন্তার বাইরে এসে রাজনীতির সঙ্কট ও অচলাবস্থা নিরসনের দিকে কি কেউ নজর দিচ্ছে?
উত্তরগুলো সবারই জানা। এটাও জানা যে, রাজনীতি সংশ্লিষ্ট সবগুলো পক্ষই চলছে নিজস্ব দলীয় স্বার্থগত অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে। দলের বাইরে এসে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক (ইনক্লুসিভ) এজেন্ডায় সঙ্কট ও অচলাবস্থা নিরসনের জন্য কেউই এগিয়ে আসছে না।
ফলে আন্দোলন যতই তীব্র হোক এবং যেকোনও পক্ষই বিজয়ী হোক, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কট ও সমস্যাগুলো কি মিটবে? কিংবা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীনরাই যদি ক্ষমতায় থেকে যায় বা বিরোধীরা যদি ক্ষমতায় আসে, তাহলেও কি রাতারাতি রাজনৈতিক সঙ্কট ও সমস্যাগুলো কর্পূরের মতো উবে যাবে?
এসব প্রশ্ন অপ্রীতিকর এবং কোনও রাজনৈতিক পক্ষকেই খুশি করার মতো নয়। তথাপি প্রশ্নগুলো উত্থাপিত হওয়া জরুরি। এসবের উত্তর খোঁজাও গুরুত্বপূর্ণ। রাজনীতিতে আন্দোলন চলবে। নির্বাচন হবে। ক্ষমতায় কেউ আসবে বা যাবে। এসবই স্বাভাবিক রীতি।
একইসঙ্গে, রাজনীতিতে বিদ্যমান সঙ্কট, অচলাবস্থা দূরীকরণের জন্য উদ্যেগী হওয়া, প্রয়োজনীয় সংস্কার করাও যে জরুরি এবং গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকারের বিষয়, এই সত্যটিকে কবুল করতেই সবার অনীহা।
ফলস্বরূপ, রাজনীতির উত্তাপ ছড়ালে, আন্দোলন ও নির্বাচনের ইস্যুতে তীব্রতা বাড়লে এবং পরিশেষে কোনও স্থিতাবস্থা বা পালাবদল হলেও দেশের সঙ্কটাপন্ন রাজনৈতিক দুর্ভাগ্যের মোচন হবে কিনা সন্দেহ। অন্ততপক্ষে, রাজনৈতিক পক্ষগুলোর অগ্রাধিকারের পর্যালোচনায় তেমন বার্তা আপাতত নেই।
ড. মাহফুজ পারভেজ, অধ্যাপক-বিশ্লেষক।
আপনার মতামত লিখুন :