টেলিগ্রাম রিপোর্ট : যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে রাতে সুষ্ঠু চিকিৎসা পাওয়া যায় না। কোন মেডিকেল অফিসার থাকেন না। রোগীদের জরুরি প্রয়োজনে কলদিয়েও মেলে না বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। একমাত্র ভরসা ইন্টার্নি ডাক্তার। অনেক সময় ইন্টার্নিও পাওয়া যায় না। তখন নার্সই ভরসা। হাসপাতালের ১০ টি ওয়ার্ডে একজন মেডিকেল অফিসারের দায়িত্ব পালনের নিয়ম থাকলেও সে দায়িত্ব বাস্তবে নেই। আছে খাতা কলমে।
হাসপাতালে প্রতি রোগীর সাথে একাধিক স্বজনের উপস্থিতি নজর কাড়ার মতো। স্বজনদের সাথে আবার শিশুও রয়েছে। এসব অবুঝ শিশু অবলীলায় নোংরা করছে হাসপাতালের পরিবেশ। কোন নিয়ম শৃঙ্খলা আছে বলে মনে হয় না।
বৃহস্পতিবার রাত ১০টা। গোটা হাসপাতাল জুড়ে নিস্তব্ধতা। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন রোগী আসে। জরুরি বিভাগের ডাক্তার সাইফুর রহমান চিকিৎসা দেন। ওয়ার্ডবয়রা জরুরি বিভাগ থেকে ট্রলিতে রোগী নিয়ে ওয়ার্ডে পৌঁছে দেন। ওয়ার্ডের সেবিকারা রোগী রিসিভ করে জরুরি বিভাগের ডাক্তারের দেয়া ব্যবস্থাপত্র মোতাবেক চিকিৎসা দেন। চিকিৎসারত রোগীদের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে পরবর্তী ভরসা ইন্টার্নি ডাক্তার।
কয়েক বছর আগেও হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভর্তি রোগীদের দেখভালের জন্য সারা রাত একজন মেডিকেল অফিসার দায়িত্ব পালন করতেন। এখন জরুরি বিভাগ ও করোনারি ওয়ার্ড ছাড়া রাতে হাসপাতালে আর কোন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দায়িত্ব পালন করেন না।
রাতে হাসপাতালে কমবেশি রোগী ভর্তি হয়। কোন কোন দিন অর্ধশতক রোগী ভর্তি হয়। আবার কোন কোন দিন সারা রাত ধরে ১৫ থেকে ২০ জন। এসব রোগীর একমাত্র ভরসা জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত ডাক্তার।
বৃহস্পতিবার ১০ নভেম্বর রাত ১০ টা থেকে ১২ টা যশোর জেনারেল হাসপাতালে রাতের রোগীদের চিকিৎসা দেখতে গিয়েছিল কল্যাণের একটি টিম। দুই ঘণ্টায় জরুরি বিভাগে ২০ জন রোগী ভর্তি হয়। শার্শা, মণিরামপুর, ঝিকরগাছা থেকে রোগী আসে হাসপাতালে।
ওয়ার্ডে যেয়ে দেখা যায় চিকিৎসারত রোগীদের শারীরিক অবস্থা সংকটাপন্ন হলে ইন্টার্নি ডাক্তারই ভরসা। কোন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার কল করলে আসে না। অথচ নিয়ম রয়েছে চিকিৎসারত রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন হলে জরুরি বিভাগ বা ওয়ার্ডের দায়িত্ব পালনকারী ডাক্তার কল দিলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আসতে বাধ্য থাকবে। কিন্তু নিয়ম কানুন খাতা কলমেই সীমাবদ্ধ।
হাসপাতালের মহিলা মেডিসিন ওয়ার্ডে রাত ১১টায় ভর্তি হন যশোর সদরের হালসা গ্রামের আছিয়া খাতুন (৬০)। তার স্বামী আব্দুল হামিদ জানান, জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ছাড়া আর কোন চিকিৎসক আসেনি। গরীব মানুষ ক্লিনিকে নেয়ার টাকা নেই। তাই এখানেই ভরসা।
হাসপাতালের পুরুষ মেডিসিন ওয়ার্ডের বারান্দায় ভর্তি ছোট শেখহাটি গ্রামের রফিকুল বিশ্বাসের (১৮) চাচী আরজিনা বেগম জানান, ঘাসমারা ওষুধ খেয়েছে রফিকুল। ভর্তি হওয়ার পর নার্স এসে চিকিৎসা দিয়ে গেছে। এখনো কোন চিকিৎসক আসলো না।
একই অভিযোগ শার্শার কাশিয়ানী গ্রাম থেকে আসা জাহিদ হাসানের (২২) মা আছিয়া খাতুনের। হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে দেখা গেছে, একজন রোগীর সঙ্গে একাধিক রোগীর স্বজন। এতে, হাসপাতালের পানির যেমন অপব্যবহার হচ্ছে তেমনই রোগীর স্বজন ও তাদের সঙ্গে থাকা ছোট ছোট শিশুরা নোংরা করছে হাসপাতালের মেঝেসহ পরিবেশ। শুধু তাই না, অতিরিক্ত স্বজন থাকায় রোগীদের নিরাপত্তার বিঘ্ন ঘটছে বলে জানান, পুরুষ মেডিসিন ওয়ার্ডের সিনিয়র নার্স শাহানাজ পারভিন।
রাত তখন পৌনে ১১টা। হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিট ভবনে পা রাখতেই নজরে পড়ে সিসিইউ ওয়ার্ডের। নিচতলায় ৬ জন রোগীর জন্য এই ওয়ার্ড। ভেতরে ঢুকতেই ফ্যানের বিকট শব্দে কান ঝালাপালা হয়।
সামনে চেয়ারে বসা ছিলেন নার্স। জানতে চাইলে বলেন, আমার নাম পাঁপড়ি রায়। ইন্টার্ন নার্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। সিনিয়র স্টাফ নার্স রোজি আপার শরীর ভাল নেই। তিনি রেস্টে আছেন। দুটো এসি থাকতে ফ্যান কেন চলছে প্রশ্নোত্তরে তিনি বলেন, দুটোই নষ্ট। ফ্যানের বিকট শব্দে রোগী তো আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে বলা হলে তিনি বলেন, আমার কিছু করার নেই।
করোনারি কেয়ার ইউনিটের তৃতীয়তলা। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই কানে আসে আর্তচিৎকার। দেখা যায় একজন রোগী দাপাদাপি করছেন। বেড নং ১৩। দুই-তিনজন মিলে তাকে বেডে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন। কি হয়েছে জানতে চাইলে হেলাল নামে এক যুবক বলেন, চাচার অবস্থা ভাল না। তিনি হার্টের রোগী। শ^াসকষ্ট হচ্ছে।
ডাক্তার ডাকেন বলা হলে হেলাল বলেন, নার্স আপারা বলছেন তাদের কিছু করার নেই। এ সময় চেয়ারে বসে খোশগল্প করতে দেখা যায় তিনজন নার্স ও দু’জন ওয়ার্ডবয়কে। তাদের কাছে ইব্রাহিম হোসেনের বিষয়ে জানতে চাইলে ঝরনা ও শিলা অধিকারী নামে দু’জন সিনিয়র স্টাফ নার্স বলেন, রোগীর অবস্থা ভাল না। ডাক্তার তৌহিদুর রহমান স্যার সাড়ে ৮টায় দেখে গেছেন। রোগীকে রেফার করা হচ্ছিল। কিন্তু তাদের ঢাকায় নেয়ার মতো সামর্থ নেই। এ রোগীর চিকিৎসা দেয়ার মতো সক্ষমতা এ হাসপাতালে নেই।
রাত সোয়া ১১টায় পুরুষ সার্জারি ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায় বারান্দার ফ্লোরে ঠাঁই হয়েছে ২২ রোগীর। প্রত্যেক রোগীর সাথে রয়েছে এক থেকে তিনজন স্বজন। একদম ঠাসাঠাসি অবস্থা। কাটা-ছেড়ার দুর্গন্ধ গোটা ওয়ার্ডকে দূষিত করে তুলেছে। কথা হয় রোগী মুরাদ হোসেনের সাথে। তিনি বলেন, ঘরের চাল থেকে পড়ে হাত ও পা ভেঙে গেছে। চিকিৎসা কেমন হচ্ছে জানতে চাইলে বলেন, এখন পর্যন্ত সব ওষুধ হাসপাতাল থেকে পাচ্ছি। তার বাড়ি সদরের কচুয়া গ্রামে।
ওয়ার্ডে দায়িত্বরত সেবিকা ও ওয়ার্ডবয়রা জানান, এখন কোন ডাক্তার নেই। কোন রোগীর জন্য প্রয়োজন হলে ইন্টার্ন চিকিৎসককে খবর দিয়ে নিচ থেকে ডেকে আনতে হয়। একই চিত্র দেখা যায় মহিলা সার্জারি ওয়ার্ডে। সেখানে পাওয়া যায়নি কোন চিকিৎসককে।
৮ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায় সেখানে রোগীর চাপে পা ফেলার জায়গা নেই। ওয়ার্ডে রয়েচে ১৪টি শয্যা এবং বাকি রোগী সব মেঝেতে। সেবিকারা জানান, এ ওয়ার্ডে ১৪টি শয্যাই বরাদ্দ রয়েছে। ওয়ার্ডের বাহিরে মেঝেতে ময়লার মধ্যে রোগী চিকিৎসা নিচ্ছে।
যশোর জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার আবদুস সামাদ বলেন, যেখানে মেডিকেল কলেজ রয়েছে সেখানে রাতে ইন্টার্নি চিকিৎসকরা দায়িত্ব পালন করেন। তারা প্রয়োজন মনে করলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ডেকে নিবেন। এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, আমাদের কিছু জনবল সংকট আছে। এছাড়া শয্যার চেয়ে রোগী বেশি থাকে। এজন্য কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। সেগুলো সমাধানে সবসময় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করছে।
আপনার মতামত লিখুন :