টেলিগ্রাম রিপোর্ট : দুর্নীতি দমন কমিশেনর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্যেশ্যে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেছেন, ‘সর্ষের মধ্যে যেন ভূত না থাকে। অন্যথায় দুদক জনগণের আস্থা হারাবে।
শুক্রবার (৯ ডিসেম্বর) সকালে রাজাধানীর শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে ২০তম আন্তর্জাতিক দুর্নীতি বিরোধী দিবসের অনুষ্ঠানে প্র্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন তিনি।
অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের রেকর্ড করা বক্তব্য প্রচার করা হয়। এতে তিনি বলেন, ‘প্রিয় কর্মচারীবৃন্দ সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের অভিভাবক হিসেবে আমি কমিশেনের সকল পর্যায়ের কর্মচারীদের অনুরোধ করব দুর্নীতি বিরোধী কার্যক্রমে তারা যেন সর্বোচ্চ ন্যায়নিষ্ঠতা প্রদর্শন করে। সর্ষের মধ্যে যেন ভূত না থাকে, অন্যথায় দুদক জনগণের আস্থা হারাবে। ’
দুর্নীতি প্রতিরোধ ও দমনে দুর্নীতি দমন কমিশনকেই (দুদক) কার্যকর ও সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতিদ বলেন, ছোট-বড়, ধনী-দরদ্রি নির্বিশেষে সবার বেলায় একই পদক্ষেপ নিতে হবে। ক্ষমতা দেওয়া হয় দায়িত্ব পালনের জন্য, দেখানোর জন্য নয়। তাই দুদকের সব কর্মাচারীকে ক্ষমতার সর্বোচ্চ প্রয়োগ করতে হবে।
এ সময় রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ১৯৭৫ সালের ২১ জুলাই জেলা গভর্নরদের উদ্দেশ্যে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর একটি ভাষণের উদ্ধৃত করেন। ওই ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘শুধু নিজেরা ঘুষ খাওয়া করাপশন নয়, এই সম্বন্ধে আমার কথা হলো, করাপ্ট পিপলকে সাহায্য করাও করাপশন। নেপোটিজমও টাইপ অব করাপশন। স্বজন প্রীতিও এক ধরনের করাপশন, আপনারা এসব বন্ধ করুন।’
রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, আপনারা জানেন দুর্নীতিতে বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় ও আপোসহীন নীতির জন্য ১৯৫৬ সালে তৎকালীন কোয়ালিশন সরকারের সময় তাকে দুর্নীতি দমন বিষয়ক মন্ত্রী করা হয়েছিল। তিনি কখনো দুর্নীতির সঙ্গে আপোস করেননি। ভাষণে বঙ্গবন্ধু বারবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিজের বলিষ্ঠ অবস্থান পরিষ্কার করেছেন।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় অবস্থানের কথা স্মরণ করে আবদুল হামিদ বলেন, স্বাধীনতার পর জাতির পিতা যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি দুর্নীতিবাজ, কালোবাজারি ও লুটেরাদারে বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। ১৯৭৫ সালে স্বাধীনতা বিরোধীদের হাতে সপরবিারে হত্যাকা-ের পর উন্নয়নের সেই গতি থমকে দাঁড়ায়।
তিনি বলেন, দীর্ঘ সংগ্রামের পর অর্জিত আমাদের এই স্বাধানীতার অন্যতম লক্ষ্য হলো, সুন্দর, মানবিক, বৈষম্যহীন ও ন্যায় ভিত্তিক দুর্নীতিমুক্ত সমাজ বিনির্মাণ। আমাদের পবিত্র সংবিধানও দুর্নীতি বিরুদ্ধে কঠোর হতে বলেছে।
সংবিধানের ২০ এর ২ অনুচ্ছেদের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রের এমন অবস্থার সৃষ্টির চেষ্টা করলে যেখানে সাধারণ নীতি হিসেবে কোনো ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করিতে সমর্থ হইবে না’- এই মর্মবাণীকে ধারণ করে দুদক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
‘দুর্নীতি শুধু বাংলাদেশ নয়, বৈশ্বিক সমস্যা’ উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, দুর্নীতি সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি করে, দুর্নীতি গণতান্ত্রিক উন্নয়ন ও বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। আমি মনে করি, মানুষের মধ্যে দুর্নীতি বিরোধী চেতনা তৈরি ও দুর্নীতিবাজদের দৃষ্টান্তমূলক শান্তির মাধ্যমে দুর্নীতি কমিয়ে আনা সম্ভব।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক আদোলন গড়ে তোলার বিকল্প নেই জানিয়ে আবদুল হামিদ বলেন, একটা সময় ঘুষখোর, সুদখোর ও দুর্নীতিবাজদের সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা ছিল না বললেই চলে। কালের বিবর্তনে সেই মূল্যবোধ ক্রমেই হারিয়ে যেতে বসেছে। শহর, বন্দর সবখানেই টাকাওয়ালাদের জয় জয়কার। টাকা কীভাবে এলো সৎ নাকি অসৎ পথে, এসব নিয়ে কারো কোনো মাথা ব্যথা নেই। এটা নিয়ে ভাববার ফুরসতও নেই। সামাজিক মর্যাদার মাপকাঠি হয়ে গেছে টাকা।
সমাজের সর্বস্তরের মানুষের টাকার পেছনে ছোটাকে অসনি শংকেত অবহিত করে তিনি বলেন, চাকরিজীবী, রাজীনীতিবিদ, পেশাজীবী, শ্রমিক, ব্যবসায়ী সবাই দেখি টাকার পেছেনে দৌঁড়াচ্ছে। সরকার ও দুদক সমাজ থেকে দুর্নীতি দূর করে দেবে, আর আমরা বসে বসে দেখব, তা কোনোভাবেই সম্ভব না। দুর্নীতি দুর করতে হলে সবাইকে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। ঘুষখোরদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, নানান চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে দেশে আজ গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, আর্থসামাজিক উন্নতি প্রতিটি সূচকে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভ করেছে। নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত হয়েছে পদ্মাসেতু। মহাকাশে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপেণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে আজ অভিজাত স্যাটেলাইট ক্লাবের গর্বিত সদস্য।
বক্তব্য শেষে দুদকের কাজের প্রশংসা করে রাষ্ট্রপতি বলেন, ক্ষমতার অপপ্রয়োগকে কঠোরভাবে দমন করতে হবে। দুর্নীতি করলে শাস্তি পেতে হয়- সমাজে এই ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আশার কথা হলো, দুদকের কার্যক্রম যুগপৎ পরিচালনা করছে।
বক্তব্যে দুদকের হটলাইন নম্বর ১০৬ এর প্রশংসা করেন রাষ্ট্রপতি। বলেন, দুদকের হটলাইন সেবাও একটি শ্রসংসনীয় উদ্যোগ। দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধকে আরও বেগবান করতে কমিশনকে সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বর্তমান প্রযুক্তির যুগে দুর্নীতিবাজদের কৌশলও পাল্টেছে। তাদের আইনের আওতায় আনতে হলে দুদককে আরও প্রশিক্ষিত হতে হবে।
দুদক চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহর সভাপতিতে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, দুদক কমিশনার জহুরুল হক, ড. মোজাম্মেল হক খান ও সংস্থাটির সচিব মো. মাহবুব হোসেন প্রমুখ।
আপনার মতামত লিখুন :