সরকারি হাসপাতাল, সিটি করপোরেশন ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে বর্জ্যকর্মী নিয়োগে ২ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা থেকে পর্যন্ত লেনদেন হয়। ৫৫ শতাংশ বর্জ্যকর্মীর নিয়োগ হয় অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে। স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে ৪৬ শতাংশ, প্রভাবশালীর হস্তক্ষেপে ৪২ শতাংশ ও সরাসরি ঘুষের মাধ্যমে ১৪ শতাংশ বর্জ্যকর্মীর নিয়োগ হয়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।
আজ মঙ্গলবার সকালে এক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে ‘চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায় শীর্ষক’ এ গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন টিআইবির রিসার্চ ফেলো মো. নেওয়াজুল মওলা। জরিপে অংশ নেওয়া ৪৫টি জেলার ১৮১টি হাসপাতাল, ৩৮ সিটি করপোরেশন-পৌরসভা, ১২টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও ৯৩ জন বর্জ্যকর্মীর দেয়া তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
সূচনা বক্তব্যে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার জন্য অপরিহার্য বিষয় হচ্ছে চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। এ খাতের সুরক্ষা ও জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়টি বিবেচনায় রেখে আমাদের গবেষণা প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, হাসপাতালগুলোতে বর্জ্যকর্মী নিয়োগে ১ থেকে ২ লাখ টাকা দুর্নীতি হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উচ্চ পর্যায়সহ বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা এই অর্থের ভাগ পান। সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় নিয়োগ পেতে একজন বর্জ্যকর্মীকে দিতে হয় ৫ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকা। মেয়র, কাউন্সিলর থেকে শুরু করে কর্মচারীরা এই অর্থ নেন। আর ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পেতে বর্জ্যকর্মীদের দিতে হয় ২ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা।
হাসপাতালের কর্মীদের একাংশ আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। একইভাবে হাসপাতালের কর্মীদের একাংশ পুনঃচক্রায়নযোগ্য চিকিৎসা বর্জ্য (ব্যবহৃত সিরিঞ্জ, ব্লেড, ছুরি, কাঁচি, রক্তের ব্যাগ ও নল, ধাতব উপকরণ ইত্যাদি) নষ্ট/ধ্বংস না করে সংক্রমিত অবস্থাতেই ভাঙারি দোকানে এবং রিসাইক্লিং কারখানাগুলোতে বিক্রি করে দেন। সংক্রমিত অবস্থায় এসব বর্জ্য পরিবহন করার ফলে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মী ও রিসাইক্লিং কারখানার কর্মীদের বিভিন্ন সংক্রমক রোগে আক্রান্ত হওয়া এবং পরিবেশ দূষণের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। একটি জেলার বিভিন্ন হাসপাতালের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রতিদিন প্রায় ৩ হাজার ৫০০ কেজি প্লাস্টিক চিকিৎসা বর্জ্য অবৈধভাবে বিক্রির অভিযোগ রয়েছে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সুশাসন নিশ্চিত করতে ৯টি সুপারিশ দিয়েছে টিআইবি। এর মধ্যে রয়েছে-প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়, তদারকি ও তত্ত্বাবধান নিশ্চিত করতে ‘কর্তৃপক্ষ’ গঠন করতে হবে এবং জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে সমন্বয় কমিটি গঠন করতে হবে, আন্তর্জাতিক মানদ- অনুসরণ এবং সংশ্লিষ্ট অংশীজনের দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে চিকিৎসা বর্জ্য (ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ) বিধিমালা, ২০০৮ সংশোধন করা, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫-এর সংশ্লিষ্ট ধারায় সুস্পষ্টভাবে চিকিৎসা বর্জ্যকে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা, চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, হাসপাতাল, সিটি করপোরেশন/পৌরসভাসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সঙ্গে সমন্বয় করে কার্যকর কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা।
এছাড়া চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সক্ষমতা ও কার্যকরতা বৃদ্ধির জন্য এই ক্ষেত্রকে অগ্রাধিকার দিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে আর্থিক বরাদ্দ বৃদ্ধি করা, চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আধুনিক এবং উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করা, প্রত্যেক সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের জন্য ইটিপি ও এলাকভিত্তিক কেন্দ্রীয় ইনসিনারেটর স্থাপন, দক্ষ জনবল দিয়ে চিকিৎসা বর্জ্য পরিশোধন ও অপসারণ, চিকিৎসা বর্জ্যের ঝুঁকি সম্পর্কে হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, স্বাস্থ্যকর্মী, চিকিৎসা বর্জ্যকর্মী এবং জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, সিটি করপোরেশন/পৌরসভায় চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য আলাদাভাবে জনবল নিয়োগ এবং যথাযথ প্রশিক্ষণ দেয়া ও চিকিৎসা বর্জ্যকর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্যবিমা সুবিধা প্রদান করার সুপারিশ দেয়া হয়।
আপনার মতামত লিখুন :