যশোর অফিস: তীব্র দাবদাহে পুড়ছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলো। গত কয়েকদিনে তাপমাত্রা রেকর্ড ৪২ দশমিক ৬ থেকে ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে এটাই দেশের সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রার রেকর্ড। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা ক্রমেই বাড়ছে। আগামী দিনগুলোয় সারাদেশে আরও গরম পড়তে পারে। বাড়তে পারে তাপমাত্রার পারদ। দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার এই রেকর্ড হয়েছে আজ সোমবার দণি-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা চুয়াডাঙ্গায়। এদিন যশোরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দাবদাহের কারণে স্থানীয় প্রশাসন মানুষকে দিনের উষ্ণতম সময়ে বাড়ির বাইরে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। এছাড়া খুলনা, সাতক্ষীরা, নড়াইল, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরে খরতাপে মারাত্নক ভোগান্তি বেড়ছে সাধারণ মানুষের। তীব্র গরমে আজ নড়াইলের লোহাগড়ার ইতনা হাই স্কুলের ১৫ শিক্ষার্থী অসুস্থ্য হয়ে পড়লে স্থানীয় ভাবে তাদেরকে চিকিৎসা দিয়ে বাড়িতে পাঠানো হয়। এর আগে গত রোববার হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে যশোর সদরের আমদাবাদ হাই স্কুলের শিক্ষক জাহিদ হাসান ও কুয়াদা হাই স্কুলের শিক্ষক আব্দুর রহমান মারা যান। এছাড়া যশোরের মণিরামপুরের রাজগঞ্জ থেকে যশোরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা একটি যাত্রীবাহী বাসের মধ্যে হিট স্ট্রকে আক্রান্ত হয়ে মারা যান খেদাপাড়া গ্রামের বৃদ্ধ আব্দুল জব্বার(৭৩) নামের এক বৃদ্ধ। এদিতে ত্রীব্র তাপদাহে ব্যাহত হচ্ছে যশোরসহ গোটা দক্ষিনাঞ্চলের মাছের রেনু পোনার উৎপাদন। অথ্যাধিক তাপমাত্রার কারনে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন হাজার হাজার দিনমজুর শ্রমিক রিকসা, ভ্যান ও ইজিবাইকের চালক। তীব্র তাপদাহের কারনে দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোলসহ দর্শনার গেদে ও সাতক্ষীরার ভোমরা এবং নওয়াপাড়া ও মংলা নৌবন্দরে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
বৈশাখের তপ্ত গরমে বিপর্যস্ত যশোর। চলছে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ। আজ এই জেলায় রেকর্ড ৪২ দশমিক ৮ ডিগ্রি তাপমাত্রা উঠার দিন সড়ক-মহাসড়কের বিটুমিন (পিচ) গলে যেতে দেখা গেছে। গরমে পিচ গলে যাওয়ায় ঝুঁকি বাড়ছে দুর্ঘটনার। এর আগের শনিবারে তাপমাত্রা ছিল ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
অন্যদিকে, তীব্র গরমে যশোর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে রোগী সংখ্যা বেড়েছে। ফলে হাসপাতালে ২৫০ শয্যার বিপরীতে বর্তমানে ১ হাজার ১৬জন রোগী ভর্তি রয়েছে। এছাড়া চলমান তাপপ্রবাহে সবজি জাতীয় ফসলের তির আশঙ্কায় রয়েছেন কৃষক। আম, কাঠাল, লিচু এবং ড্রাগন ফলের ফুল-ফল ঝরে যাচ্ছে। তীব্র পানি সংকট বিরাজ করছে গোটা দক্ষিনাঞ্চলে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ার কারনে যশোরসহ গোটা দক্ষিণ পশ্চিাঞ্চলে পানি সংকট দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব জেলঅর অধিকাংশ অগভীর নলকুপে পানি উঠছে না। ডিপ টিউবওয়েল ও সাব মার্সিবলে পানি ওঠার মাত্রাও কমে গেছে বহুগুনে।
আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছেন, বৈশাখের শুরু থেকেই সারাদেশে তাপদাহ শুরু হয়। এখন গরম তীব্র থেকে অতি-তীব্র আকার ধারণ করছে।
গত বৃহস্পতিবার যশোরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০ দশমকি ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শুক্রবার রেকর্ড করা হয় ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শনিবার ছিল ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল। রোববার যশোরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০ দশমকি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর আজ যশোরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল দুপুর ২টায় ৪২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এদিরে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় চুয়াডাঙ্গায় ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
এদিকে, যশোর-নড়াইল, যশোর-ঝিনাইদহ ও যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের কিছু কিছু স্থানে তাপপ্রবাহের কারণে বিটুমিন গলে যাওয়ায় সড়কের কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। রাস্তায় যানবাহনের চলাচল সীমিত হয়ে পড়েছে।
সড়ক ও জনপথ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, সাধারণত সড়কে যে পিচ ব্যবহার করা হয় তা ৬০-৭০ গ্রেডের। এর গলনাঙ্ক ৪৮ থেকে ৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ তাপমাত্রা ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠলে পিচ গলার কথা। কিন্তু তার অনেক আগেই পিচ গলে যাচ্ছে।
ঝুমঝুমপুর বাজারের ব্যবসায়ী মনিরুল ইসলাম জানান, রাস্তায় হাঁটতে গেলে জুতো স্যান্ডেল পিচে আটকে যাচ্ছে। দু’একজন পিচ থেকে তুলতে না পেরে স্যান্ডেল রেখেই চলে যাচ্ছেন। গাড়ির চাকার চাপায় তা রাস্তার পিচের সঙ্গেই আটকে থাকছে।
সড়ক ও জনপথ অধিদফতর যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম কিবরিয়া জানান, যশোর-নড়াইল ও যশোর – খুলনা সড়কের যেসব স্থানে বিটুমিনের পরিমাণ বেশি পড়েছে, প্রচণ্ড গরমে সেসব জায়গা গলে যাচ্ছে। এজন্য সড়কের গলে যাওয়া স্থানে বালি ও নুড়িপাথর দেওয়া হচ্ছে। যাতে গলে যাওয়া পিচ আগের অবস্থায় থাকে।
যশোর কৃষি অধিদফতরের উপপরিচালক ড. সুশান্ত কুমার তরফদার বলেন, সাধারণত অতিরিক্ত তাপে মাঠিতে পানির অভাব দেখা দেয়। আর বর্তমানে যশোর জেলায় যে পরিমাণ তাপ তাতে লতা জাতীয় সবজি পুড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। আর এভাবে তাপ চলতে থাকলে সবজি এবং ফল জাতীয় ফসলে ব্যাপক তির সম্ভাবনা রয়েছে। আম, লিচু, কাঁঠাল ঝরে পড়ছে এবং সবজি জাতীয় ফসলে ফুল-ফল কম এবং শুকিয়ে যাচ্ছে।
যশোর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে তত্ত্বাবধায়ক ডাক্তার হারুন অর রশিদ জানান, তীব্র গরমে যশোর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। বর্তমানে হাসপাতালে ২৫০ শয্যার বিপরীতে ১ হাজার ১৬জন রোগী ভর্তি আছে। গরমের সমস্যা নিয়ে ২০০’র বেশী রোগী ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ৭০জন শিশু এবং বয়স্করা রয়েছে ১৩০জনের মতো। অত্যাধিক গরমে ডায়রিয়া ও হিট স্ট্রকের রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
তিনি আরও বলেন, জায়গার সঙ্কটের কারণে হাসপাতালে বারান্দায় রোগী থাকছে। পর্যাপ্ত ফ্যান না থাকায় রোগীরা গরমে ভুগে আরো বেশি অসুস্থ্য হয়ে পড়ছেন।
তাপপ্রবাহে বিপর্যস্ত চুয়াডাঙ্গা
চুয়াডাঙ্গার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া তীব্র তাপপ্রবাহ এখন প্রকট আকার ধারণ করে রূপ নিয়েছে ‘অতি তীব্র’ তাপপ্রবাহে। এই জেলায় প্রতিদিনই বাড়ছে তাপমাত্রা। টানা ১০ দিন বয়ে যাওয়া তাপ প্রবাহে অতিষ্ঠ এখানকার জনপদ। সর্বশেষ আজ সোমবার এই জেলায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাতত্রা রেকর্ড করা হয় ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা গত ৭৬ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বলছে আবহাওয়াবিদগণ। ক্রমেই এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে ৪৭ ডিগ্রি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে বলে আশঙ্কা আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের। গতকাল রোববার সন্ধ্যা ৬ টায় চুয়াডাঙ্গার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪১ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত শনিবার এ জেলায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪২ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা ছিল এ জেলায় এই মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। আজ সোমবার সেই তাপমাত্রা পূর্বের সব রেকর্ড ভেঙ্গে পৌঁছে যায় ৪৩ ডিগ্রিতে।
টানা অতি তাপে বিপাকে পড়েছেন নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষ। প্রয়োজনের তাগিদে ঘর থেকে বেরিয়েও কাজ করতে পারছেন না তারা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যেমন রোদের প্রখরতা বাড়ছে তেমনি বেলা গড়ালেও উত্তাপ কমছে না। দিনের মতো রাতেও গরম অনুভূত হচ্ছে। এদিকে এই তীব্র গরমে বিদ্যুৎ সংকট মারাত্নক আকার ধারন করায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে জনজীবন। রাত দিন ২৪ ঘন্টার মধ্যে গ্রামাঞ্চলে গড়ে ৪/৫ ঘন্টারবেশি বিদ্যুৎ থাকছে না। রাতের বেলায় এই সংকট আরো বাড়ছে।
এসব জেলার হাসপাতাল গুলোতে বাড়ছে গরমজনিত রোগীর সংখ্যা। অতিরিক্ত গরম ও তীব্র তাপের কারণে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালসহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, জ্বরসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে শত শত শিশুসহ বিভিন্ন বয়সী রোগীরা বহির্বিভাগ ও ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছে। তীব্র গরমের ফলে বাড়ছে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে প্রতিদিন শিশু ওয়ার্ডে কমপে ৫০ থেকে ৬০ জন শিশু ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন এবং বহির্বিভাগেও প্রতিদিন অন্তত এক হাজার রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন।
আপনার মতামত লিখুন :