ঢাকা ০৬ মে ২০২৪, সোমবার, ২৩শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
২৫শে শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

ঋণদান সমিতি খুলে গ্রাহকদের শত কোটি টাকা প্রতারণা সাতক্ষীরার প্রগতি সঞ্চয় ও ঋণদান কো-অপারেটিভ সোসাইটির মালিক প্রাণনাথ দাস ভারতে গ্রেপ্তার


টেলিগ্রাম রিপোর্ট প্রকাশের সময় : মার্চ ২১, ২০২৪, ১০:৩১ পূর্বাহ্ণ / ২৭২২০
ঋণদান সমিতি খুলে গ্রাহকদের শত কোটি টাকা প্রতারণা সাতক্ষীরার প্রগতি সঞ্চয় ও ঋণদান কো-অপারেটিভ সোসাইটির মালিক প্রাণনাথ দাস ভারতে গ্রেপ্তার

রঘুনাথ খাঁ,সাতক্ষীরা: গ্রাহকদের শতকোটি টাকা প্রতারণা করে স্বপরিবারে পালিয়ে যাওয়া সাতক্ষীরায় প্রগতি সঞ্চয় ও ঋণদান কো-অপারেটিভ সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক প্রাণনাথ দাসকে অবশেষে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের গোয়েন্দা পুলিশ (এসডিএফ) গ্রেপ্তার করেছে। রবিবার রাতে তাকে উত্তর ২৪ পরগণা জেলার গোবরডাঙা থানাধীন জামদানি এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তারকৃত প্রাণনাথ দাস(৪৬) সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার টিকেট গ্রামের মৃত জুড়ন দাসের ছেলে ও বর্তমাসে পুরাতন সাতক্ষীরার বাসিন্দা।
এদিকে ভারতে প্রাণনাথ দাস গ্রেপ্তার হলেও তার ম্যানেজার বহু অপকর্মের হোতা শ্যামনগর উপজেলার ভেটখালি নতুনঘেরি এলাকার কৃষ্ণপদ মণ্ডলের ছেলে মিলন মণ্ডল রয়েছেন বহাল তবিয়তে। তবে প্রাণনাথের গ্রেপ্তারের খবর আকাশ বানী কোলকাতা, ডিডি-১ টেলিভিশন ও আনন্দবাজার পত্রিকাসহ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রচার হওয়ায় মিলন মণ্ডলকে গ্রেপ্তার করাটা এখন সময়ের দাবি।
গোবরডাঙা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পিংকি রাণী ঘোষ জানান, অবৈধপথে বাংলাদেশ থেকে ভারতে এসে অবস্থান করছেন এমন গোপন খবরের ভিত্তিতে পশ্চিমবঙ্গ গোয়েন্দা পুলিশের (এসডিএফ) একটি দল গত রবিবার রাতে প্রাণনাথ দাসকে জামদানি গ্রামের একটি বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে। পরে তাকে গোবরডাঙা থানায় সোপর্দ করা হয়। এ ঘটনায় অবৈধপথে ভারতে আসার অভিযোগে পুলিশ বাদি হয়ে প্রাণনাথের বিরুদ্ধে ফরেনার এক্ট ১৪(এ) ধারায় একটি মামলা(জিআর-৭৮/২৪) দায়ের করেন। ১৮ মার্চ তাকে বারাসাত সহকারি বিচারিক হাকিমের (এসিজেএম) আদালতে তোলা হয়। বিচারক তাকে ১৪ দিনের জেল হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
তবে গোবরডাঙা থানা সূত্রে জানা গেছে, প্রাণনাথ গ্রেপ্তার হওয়ার কয়েকদিন আগে থেকে তাকে পাওয়া যাচ্ছিল না। এ ঘটনায় তার স্ত্রী ইতি রানী বিশ্বাস সাতক্ষীরা সদরের গোয়ালপোতা গ্রামের ঠাকুরদাস মণ্ডলের নামে থানায় একটি মিসিং জিডি করেন। তবে জিডিতে ইতি রানী বিশ্বাস কোন ঠিকানা ব্যবহার করেছিলেন তা জানার চেষ্টা চলছে।

ঘটনার বিবরনে জানা যায়,া প্রাণনাথ দাস ২০০২ সালে রুপালী লাইফ ইনসিওরেন্স নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জেলা ও জেলার বাইরে বেশ কিছু মানুষের সঙ্গে প্রতারণার মাধ্যমে বহু টাকা আত্মসাৎ করেন। পরে ২০১২ সালে ১২১ নং সমবায় রেজিষ্ট্রেশন মূলে প্রগতি সঞ্চয় ও ঋণদান কো-অপারেটিভ সোসাইটি খোলেন প্রাণনাথ দাশ। সোসাইটির চেয়ারম্যান হিসেবে নিজের স্ত্রী ইতি রানী বিশ্বাস, সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বড় ভাই বিশ্বনাথ দাশকে নিযুক্ত করে গত ১০ বছরে ডিপিএস ও ফিক্সড ডিপোজিট এর মাধ্যমে শত গ্রাহকদের কাছ থেকে শত কোটি টাকা প্রতারণা করেন। প্রতারণার টাকা দিয়ে তিনি পুরাতন সাতক্ষীরায় বাড়িসহ গাভায় চার বিঘা জমি, সদুরডাঙিতে দুটি বাড়ি, বুধহাটায় দুটি অফিস, মুন্সিপাড়ায় চার শতক জমি ও পুরাতন সাতক্ষীরায় দুটি শোরুম খোলেন। জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘোরাতে প্রাণনাথ সাতক্ষীরা মন্দির সমিতির সাংগঠণিক সম্পাদক, বাস মলিক সমিতির সাংগঠণিক সম্পাদকসহ বিভিন্ন সংগঠণের ভাল ভাল পদ অলঙ্কৃত করেন। করেন কুলিয়া ইউপি নির্বাচন। একপর্যায়ে প্রাণনাথ টিকেট গ্রামে নিজের পৈতৃক ১১ বিঘা জমি, মুন্সিপাড়ার চার শতক জমি, গাভার জমিসহ সদুরডাঙার একটি বাড়ি, কুল্ল্যার দুটি অফিস বিক্রি করে দেন। বিক্রি করেন তার কয়েকটি বাস ও প্রাইভেটকার। সদুরডাঙির একটি বাড়ি ও পুরাতন সাতক্ষীরার বাড়ি প্রাইম ব্যাংক সাতক্ষীরা শাখা থেকে এক কোটি ১৩ লাখ টাকার ঋণ নেওয়ায় তা আর হস্তান্তর হয়নি। এসব জমি বিক্রি করার খবর পেয়ে গ্রাহকরা মুনাফা ও আসল টাকা ফেরৎ চাইলে প্রাননাথ টালবাহানা শুরু করেন।
এসব টাকা ফিরে পেতে তারা প্রশাসনের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের নেতাদের শরনাপন্ন হয়েও কোন প্রতিকার না পেয়ে ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ভূধর সরকারসহ শতাধিক ব্যক্তি চলতি বছরের ১৮ অক্টোবর সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক, র‌্যাব- ৬ ও পুলিশ সুপারসহ বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করেন। অভিযোগপত্রে প্রাননাথ দাশ, তার ভাই বিশ্বনাথ দাশ ও স্ত্রী ইতি রানী বিশ্বাস যাতে গ্রাহকদের বিপুল পরিমান টাকা বিদেশে পাঠিয়ে নিজেরা পালাতে না পারে সেজন্য তাদের পাসপোর্ট জব্দ করার আবেদন করা হয়। এরপরও কতিপয় গ্রাহক টাকা পাওয়ার দাবিতে গত ১৮ ডিসেম্বর প্রাণনাথের বাড়ি ঘেরাও করে বিক্ষোভ করেন। বিক্ষোভ চলাকালে প্রাণনাথ দাশ অজ্ঞাত স্থানে থেকে উত্তর রাজারবাগানের আসাদুজ্জামান তুহিন আন্দোলনকারিদের হুমকি দেন। ২০ ডিসেম্বর মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে প্রাণনাথের স্ত্রী ও মেয়ে শ্যামনগর উপজেলার ভেটখালি গ্রামের প্রাননাথ দাসের দক্ষিনহস্ত কৃষ্ণপদ মণ্ডলের ছেলে মিলন মণ্ডল, প্রাণনাথ দাসের ভায়রা ভাই যশোর জেলার কোতোয়ালি থানার ডহরসিংগা গ্রামের নির্মল কুমার দাশের ছেলে মিঠুন কুমার দাশ, আসাদুজ্জামান তুহিনসহ কয়েকজনের সহযোগিতায় বাড়ি থেকে বের হয়ে একটি ইজিবাইকে উঠে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি দেন।
প্রাণনাথের স্বপরিবারে ভারতে চলে যাওয়ার খবরে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের পক্ষ থেকে ২১ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করা হয়। বিকেল চারটায় ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহক অরুন কুমার কর্মকার বাদি হয়ে প্রাণনাথ, স্ত্রী ইতি রানী বিশ্বাস ও বড় ভাই বিশ্বনাথ দাশ এর বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করেন। ২০ ডিসেম্বর ভোর ৬টার দিকে রাজারবাগান এলাকার আসাদুজ্জামান তুহিন, কাটিয়া সরকারপাড়ার প্রভাষচন্দ্র গাইনসহ ৮/১০ জন তার মালিকানাধীন প্রগতি এন্টারপ্রাইজের শার্টারের তালা ভেঙে দুটি ট্রাকে করে ১২ লাখ টাকা মূল্যের এক হাজার গ্যাস ভর্তি সিলিণ্ডার লুট করে নিয়ে যায়। দুপুরে গ্যাসভর্তি সিলিণ্ডারবহনকারি একটি ট্রাক খুলনার সোনাডাঙা থানার পুলিশ আটক করে। ওইদিন প্রাণনাথ দাসের ম্যানেজার ভেটখালির মিলন মণ্ডল পুরাতন সাতক্ষীরার ও আশাশুনির কুল্ল্যার মোড়ের দুটি শোরুরম থেকে প্রগতি এন্টারপ্রাইজের শোরুমের তালা থেকে টিভি, ফ্রিজসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র নিয়ে শ্যামনগরের ভেটখালি পুরাতন নৌপুলিশ ফাঁড়ির পূর্ব পাশে আরব আলীর বাসায় ও তার বাবা কৃষ্ণপদ মণ্ডলের চায়ের দোকানে রেখে দেয়। বর্তমানে মিলন মণ্ডল আরব আলীর বাড়ির নীচেরতলায় দোকান ও দোতলায় গুদাম খুলে ব্যবসা পরিচালনা করছে। বিষয়টি নিয়ে গুঞ্জন ওঠায় প্রাণনাথের সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই এমন একটি নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে চুক্তিপত্র দেখাচ্ছেন। তবে মিলন মণ্ডলের ভগ্নিপতি মানিকখালির বিশ্বজিৎ মণ্ডল জানান, বোন রীতার(বিশ্বনাথের স্ত্রী) মাধ্যমে মিলন তাকে প্রগতি সংস্থায় অধিক লাভে ১২ লাখ টাকা জমা দিতে বলে তাকে প্রতারণা করেছে। তিনি এখন পথের ফকির।
স্থানীয়রা জানান, প্রাণনাথ জনরোষে পড়ে গত বছরের ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিক থেকে মিলন মণ্ডলের পরামর্শে নতুনঘেরি এলাকায় থাকতো। মিলনের সহযোগিতায় প্রাণনাথ হরিনগর বাজারের এক বিকাশ এজেন্টের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা গুগল পে বা ফোন পে এর মাধ্যমে ভারতে পাঠিয়েছে। স্ত্রী ও মেয়েকে মিলনের সহযোগতিায় ২০ ডিসেম্বর নতুৃনঘেরীতে আনার পরদিন প্রাণনাথ দাস রমজাননগরের সীমান্তবর্তী কালিন্দি নদী পাড়ি দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোলকাতার দমদম এলাকার নিউটাউনের বাড়িতে চলে যান। প্রাণনাথের আত্মসাৎ করা বড় অংকের টাকার একটি অংশ ও বিভিন্ন মালামাল মিলন আত্মসাৎ করে নিজের ভাগ্য পরিবর্তণ করেছে। এ ছাড়া সাতক্ষীরা সদরের গোয়ালপোতা গ্রামের ঠাকুরপদ মণ্ডল বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের বারাসাতের পার্শ্ববর্তী হৃদয়পুরে বসবাসের সুবাদে প্রাণনাথ তার সঙ্গে সখ্যতা রেখে নিউটাউনে জমি কিনে বাড়ি তৈরিসহ বিভিন্ন ব্যাংকে টাকা জমিয়েছেন। ১১ মার্চ থেকে প্রাণনাথকে খুঁজে না পাওয়ায় তার স্ত্রী ইতি রানী বিশ্বাস ক্ষুব্ধ হয়ে গোবরডাঙা থানায় মিসিং জিডি করেন। তবে প্রাণনাথ দাস গ্রেপ্তার হওয়ার পর ঠাকুরদাস মণ্ডল আত্মগোপন করেছেন।
এদিকে পরষ্পর যোগসাজসে আট জনের কাছ থেকে ২৪ লাখেরও বেশি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে আশাশুনি উপজেলার পাইথলি গ্রামের অসিত দাসের ছেলে নীলমনি দাস গত ২৩ জানুয়ারি সাতক্ষীরার আমলী আদালত-৮ এ প্রাণনাথ দাস, তার স্ত্রী ইতি রানী বিশ্বাসসহ ১০জনের নামে মামলা করলে বিচারক জিয়ারুল হক গত ২৪ ফেব্রুয়ারি তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সাতক্ষীরার পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশন কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিলেও আজো কোন প্রতিবেদন দাখিল করেননি।

 

 

Archive Calendar

Mon Tue Wed Thu Fri Sat Sun
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031