ঢাকা ০৬ মে ২০২৪, সোমবার, ২৩শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
২৫শে শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

অস্তিত্ব রক্ষায় এখন সেই রোহিঙ্গাদেরই সহায়তা চাইছে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা


টেলিগ্রাম রিপোর্ট প্রকাশের সময় : এপ্রিল ৮, ২০২৪, ৩:১৯ অপরাহ্ণ / ২৭২২০
অস্তিত্ব রক্ষায় এখন সেই রোহিঙ্গাদেরই সহায়তা চাইছে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী, সামরিক জান্তা এক সময় অকাতরে গণহত্যা চালিয়েছে রোহিঙ্গাদের ওপর। বিশেষ করে ২০২১ সালের ১লা ফেব্রুয়ারির অভ্যুত্থানের পর গণতন্ত্রকামী মানুষের গণবিক্ষোভ, আন্দোলন এবং তার সঙ্গে জাতিগত বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর যোগ দেয়ার পর ক্রমশ কোণঠাসা হতে থাকে তারা। গত অক্টোবর থেকে বিদ্রোহীদের একের পর এক অভিযান, হামলায় দিশেহারা সামরিক জান্তার সেনারা। তারা একের পর এক এলাকার নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকে। পরাজিত হচ্ছে বিভিন্ন শহরে। হারাচ্ছে আউটপোস্ট, ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর। পালিয়ে সেনাবাহিনীর অনেক সদস্য সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ও ভারতে আশ্রয় নিচ্ছেন মাঝেমধ্যেই। উপায়ান্তর না দেখে সব যুবক-যুবতীর জন্য সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করেছে জান্তা সরকার। কিন্তু কিছুতেই শেষ রক্ষা হচ্ছে না। ফলে তারা যে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছিল, তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছিল, গ্রামের পর গ্রাম নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে, ধর্ষণ চালিয়েছে- সেই রোহিঙ্গাদের কাছে এখন তারা সাহায্য চাইছে।

বিভিন্ন সময়ে গণহারে সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের হত্যা করেছে। ফলে বাধ্য হয়ে তারা পালিয়ে দলেবলে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। এ খবর দিয়েছে অনলাইন বিবিসি।

প্রায় সাত বছর আগে হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলিমকে হত্যা করেছে সেনাবাহিনী। এই হত্যাকে জাতিনিধন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে জাতিসংঘ। বিবিসি বলছে, এখন সেই রোহিঙ্গাদের কাছে সাহায্য চাইছে সামরিক জান্তা। সম্প্রতি রাখাইনে বসবাসরত কমপক্ষে ১০০ রোহিঙ্গার সাক্ষাৎকার নিয়েছে বিবিসি। এসব রোহিঙ্গা সামরিক জান্তার পক্ষে যুদ্ধে যেতে বাধ্য হয়েছেন কয়েক সপ্তাহ আগে। এ নিয়ে রিপোর্টে ওইসব রোহিঙ্গার নাম পাল্টে দিয়ে বিবিসি বলছে- তাদের একজন ৩১ বছর বয়সী মোহাম্মদ। তিনি এই যুদ্ধে গিয়েছেন। তিনি বলেন, আমি যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তাবে ভয়ে ছিলাম। কিন্তু আমাকে যেতেই হয়েছে (অর্থাৎ তাকে বাধ্য করা হয়েছে)। তার বসবাস রাজ্যের রাজধানী সিতওয়ের কাছে বাউ ডু ফা ক্যাম্পে। গত এক দশকে আইডিপি ক্যাম্পে বসবাস করতে আভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত কমপক্ষে দেড় লাখ রোহিঙ্গাকে বাধ্য করা হয়েছে। মোহাম্মদ বলেন, ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি ক্যাম্প লিডার এক রাতের শেষের দিকে উপস্থিত হন এবং বলেন, তাকে সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে হবে। মোহাম্মদের ভাষায়, এটা ছিল সামরিক নির্দেশ। ওই লিডার আমাকে বলেন, যদি আমি এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করি তাহলে তারা আমার পরিবারের ক্ষতি করবে।

বেশ কিছু রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি। এসব রোহিঙ্গা নিশ্চিত করে বলেছেন, সেনা কর্মকর্তারা ক্যাম্পে ঘোরাঘুরি করতেন এবং যুবকদেরকে নির্দেশ দিতেন সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণে রিপোর্ট করতে।
মোহাম্মদের সঙ্গে যে ভয়াবহতা ঘটে গেছে তাতে এটাই প্রমাণিত হয় যে, তাদেরকে এখনও মিয়ানমারের নাগরিকত্ব প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে। দেশের ভিতরে পর্যন্ত তাদের চলাচলে বিভিন্ন রকম বিধিনিষেধ আছে। ২০১২ সালে কয়েক লাখ রোহিঙ্গাকে রাখাইন রাজ্যে গাদাগাদি ক্যাম্পে যেতে বাধ্য করা হয়। এর ৫ বছর পর ২০১৭ সালে ৭ লাখ রোহিঙ্গা নিষ্পেষণ, নৃশংসতা থেকে রক্ষা পেতে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। এখনও রাখাইনে আছেন প্রায় ৬ লাখ রোহিঙ্গা। এই সম্প্রাদায়ের ওপর চালানো গণহত্যার অভিযোগে হেগে অবস্থিত জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালত ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে (আইসিজে) বিচার চলছে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে।

কিন্তু কি নির্মম পরিহাস! সেই রোহিঙ্গাদেরকেই এখন নিজেদের অস্তিত্ব টেকানোর জন্য সেনাবাহিনীতে জোর করে যুক্ত করাচ্ছে সেই গণহত্যা চালানো সেনাবাহিনী। অথচ সামরিক অভ্যুত্থানের পর সামরিক বাহিনীর গুলি, গোলা এবং আকাশ থেকে ফেলা বোমা হামলায় কত রোহিঙ্গা এবং অন্য সম্প্রদায়ের মানুষ নিহত হয়েছেন তার কোনো হিসাব নেই। উল্লেখ্য, সর্বশেষ গত শনিবার মায়াবতী শহরের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে সেনাবাহিনী। এটি হলো থাইল্যান্ড সীমান্তের কাছের একটি শহর। এই শহরের ভিতর দিয়ে মিয়ানমারের গুরুত্বপূর্ণ সব স্থলবাণিজ্য পরিচালিত হয়। বিপুল সংখ্যক সেনা সদস্যও হারিয়েছে সামরিক জান্তা। তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে, তারা আহত হয়েছেন, আত্মসমর্পণ করেছেন অথবা পক্ষ ত্যাগ করেছেন। ফলে তাদের এই শূন্য পদে জনশক্তি দেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। আবার কিছু সেনা জনপ্রিয়তা হারানো এই শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে লড়াই করে নিজের জীবন বিলিয়ে দেয়ার ঝুঁকি নিতে চান না। এটাকেই এখন রোহিঙ্গারা কারণ হিসেবে দেখছেন। তারা মনে করছেন ওই শূন্য পদগুলো পূরণ করতে এখন তাদের কদর বেড়েছে।

মোহাম্মদ বলেন, তাকে গাড়িতে করে সিতওয়ের ২৭০তম লাইট ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়নের ঘাঁটিতে নিয়ে যাওয়া হয়। ২০১২ সালের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সময় থেকে তাদেরকে শহর থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। এমন রোহিঙ্গাদের শহরের ভিতরে চলাফেরায় বিধিনিষেধ দেয়া হয়েছে। মোহাম্মদ বলেন, কিভাবে বুলেট ভরতে হবে এবং গুলি চালাতে হবে আমাদেরকে তা শিখানো হয়েছে। সেনাবাহিনী আমাদেরকে শিখিয়েছে কিভাবে একটি বন্দুক থেকে গুলি বের করতে হয় এবং কিভাবে গুলি ভরতে হয়। মোহাম্মদকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে দুই সপ্তাহ। তারপর বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু দু’দিন পরেই আবার তার ডাক পড়েছে। আড়াইশ সেনা সদস্যের সঙ্গে একটি বোটে উঠতে বাধ্য করা হয়। তাদেরকে নৌপথে ৫ ঘন্টার সফরে নিয়ে যাওয়া হয় রাথেডাং। সেখানে পাহাড়ি তিনটি সামরিক ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণে থাকা আরাকান আর্মির সঙ্গে তীব্র লড়াই হয়। মোহাম্মদ বলেন, আমি জানি না কেন এই যুদ্ধ করছি। যখন সেনাবাহিনী রাখাইন গ্রামে গুলি করতে বলে, আমাকে গুলি করতে হয়।

সেখানে ১১ দিন যুদ্ধ করেছেন মোহাম্মদ। কিন্তু তাদের মজুদাগারে এক পর্যায়ে গোলা এসে আঘাত করার পর খাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দেয়। এই হামলায় রোহিঙ্গাদের থেকে জোর করে এনে সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়া বেশ কয়েকজন মারা যান। মোহাম্মদের দুই পায়ে গুলি লাগে। তাকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় সিতওয়েতে। ওই যুদ্ধের ছবি ২০শে মার্চ প্রকাশ করে আরাকান আর্মি। তার আগে তারা তিনটি ঘাঁটি দখলে নেয়। ছবিতে দেখানো হয় বেশ কিছু মৃতদেহ। তার মধ্যে কমপক্ষে তিনজনকে রোহিঙ্গা হিসেবে শনাক্ত করা হয়। মোহাম্মদ বলেন, যখন যুদ্ধের মধ্যে ছিলাম তখন সারাক্ষণই ভয়ে ছিলাম। সব সময় পরিবারের লোকজনের কথা ভেবেছি। কখনো ভাবিনি যে এমন যুদ্ধ করতে হবে আমাকে। আমি শুধু বাড়ি ফিরতে চেয়েছি। হাসপাতাল থেকে মুক্তি পেয়ে বাড়ি গিয়ে প্রথমেই আমার মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছি। মনে হয়েছে মায়ের গর্ভ থেকে নতুন করে জন্ম হলো আমার।

Archive Calendar

Mon Tue Wed Thu Fri Sat Sun
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031